অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ডন চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান 'ছোড়া গঙ্গা কিনারেওয়ালা'-এর ওপর ভিত্তি করে প্যারোডি ‘জিত গয়া বাবা বুলডোজারওয়ালা... হো গয়া দুশমন কা মুহ কালা।’ উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সদরদপ্তরের ভেতরে এই প্যারোডি গান এখন যেন থামছেই না। কারণ বুলডোজার বাবার ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
সমাজবাদী পার্টি (এসপি) নেতা অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে ‘বুলডোজার বাবা’ বলে ব্যঙ্গ করেন। উনি নাকি বুলডোজারের মতো মাফিয়া দমন করেছেন বলে দাবি করতেন। কথায় আছে উত্তরপ্রদেশে নাকি পরপর দুবার জেতা যায় না। যে মুখ্যমন্ত্রী শাসনকালে নয়ডা যান, তার ভোটে হার নিশ্চিত। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোট ঘিরে থাকা যাবতীয় প্রচারকে কার্যত গুঁড়িয়ে দিয়ে লক্ষ্ণৌয়ের মসনদে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন ‘বুলডোজার বাবা’ যোগী আদিত্যনাথ। পাক্কা ৩৭ বছর পরে উত্তরপ্রদেশের কুর্সিতে কোনো একজন মুখ্যমন্ত্রী পরপর দুবার দায়িত্ব নিতে চলেছেন, যা আগামী দিনে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের রাস্তা খুলে দিতে পারে বলে আশায় বুক বাঁধছেন যোগী-ঘনিষ্ঠরা।
বিশ্লেষকদের মতে, উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে মন্দির গড়া নিয়ে কোনো আবেগ তৈরি করা সংগত কারণেই এবার সম্ভব ছিল না বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে। কিন্তু মন্দিরকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের রাস্তা প্রস্তুত করাটাই ছিল যোগী আদিত্যনাথের অন্যতম তুরুপের তাস। অযোধ্যায় রামমন্দির এবং বারানসীতে কাশী বিশ্বনাথ করিডর তৈরি করে কোভিডের ধাক্কায় ঝিমিয়ে পড়া রাজ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাকা কিছুটা হলেও ঘোরাতে পেরেছে যোগী সরকার। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, হিন্দুত্বের সঙ্গে কমর্সংস্থান এবং বাণিজ্যের মিশেল এবার যোগীকে পরপর দুবার উত্তরপ্রদেশ জয়ের রেকর্ড গড়ার দিকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ও আলোচিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশের (ইউপি) সাম্প্রতিক নির্বাচনে আরামদায়ক জয়ের জন্য শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রস্তুত ছিল বলেই মনে হচ্ছে। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেখানে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে বিজেপির জয়লাভ সিকি শতাব্দীর ছন্দে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
কামানো-মাথা, জাফরান-পরা হিন্দু সন্ন্যাসী-রাজনীতিবিদ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সামনে থেকে দলের প্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ দৃশ্য আমরা গত কয়েক মাস ধরেই দেখে আসছি। গাঁদা ফুল দিয়ে সজ্জিত একটি ট্রাক, সরু যানজটপূর্ণ রাস্তা ভেদ করে এগিয়ে চলেছে। হাজার হাজার সমর্থক তাকে উত্সাহিত করার জন্য পথে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অনেকে বারান্দা এবং ছাদে দাঁড়িয়েছেন এক ঝলক দেখার জন্য, তারা তার ওপর গোলাপের পাপড়ি বর্ষণ করছেন: নির্বাচনি শোভাযাত্রা যেন এক ‘রথযাত্রা’য় পরিণত হয়েছিল।
যোগী আদিত্যনাথ ভারতে অত্যন্ত বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তার অনুসারীদের কাছে তিনি একজন পবিত্র মানুষ, একজন হিন্দু আইকন, একজন পুনর্জন্ম নেয়া দেবতা বা স্বয়ং ভগবান। দেখা যাচ্ছে, একদল মানুষ যেমন তাকে ভালোবাসেন, আবার আরেক দল একইভাবে ঘৃণাও করেন।
সমালোচকরা তাকে ভারতের সবচেয়ে বিভাজনকারী এবং অপমানজনক রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্ণনা করেন, যিনি প্রায়শই তার নির্বাচনি সমাবেশগুলোকে মুসলিম-বিরোধী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে হিন্দুদের উত্তেজিত করেন। গত পাঁচ বছরের শাসনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার বেফাঁস এবং ঘৃণামূলক বক্তব্য নিয়মিতভাবে ভারতের জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র আন্তধর্মীয় বিয়ের বিরুদ্ধে একটি বিতর্কিত আইন এনেছে। কসাইখানা ও গরুর মাংস পরিবেশনকারী রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই ক্ষমতায় তার দ্বিতীয় মেয়াদ প্রত্যাবর্তন রাজ্যের ৫ কোটি মুসলমানকে আরও কোণঠাসা করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশ ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি। গত পাঁচ বছরে এটি আরও পশ্চাদপসরণ করেছে। এর অর্থনীতির মন্দাভাব কাটছে না, বেকারত্ব বেড়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। এখানে নারীর বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপরাধের খবর বারবার জাতীয় শিরোনাম হয়েছে। করোনা মহামারির দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য গত বছর রাজ্যটি সংবাদে ছিল। হাজার হাজার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উনুন দিনরাত জ্বলেছে এবং ভারতের পবিত্রতম গঙ্গা নদীতে লাশ ভেসে ফুলে উঠে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যে চলে গেছে। তবে সাধারণ মানুষের প্রকাশ্য প্রতিবাদ ও হতাশা সত্ত্বেও বিজেপি এই নির্বাচনে জিতে ইতিহাস রচনা করেছে। কীভাবে এটা ঘটল, তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।
বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ২৫৫টি বিধানসভা আসন জিতেছে এবং এর মিত্র আপনা দল (এস) এবং নিষাদ পার্টি যথাক্রমে ১২টি এবং ৬টি আসন পেয়েছে। সমাজবাদী পার্টি জিতেছে ১১১টি আসন এবং তার জোটের অংশীদার সুহেলদেব ভারতীয় সমাজপার্টি এবং রাষ্ট্রীয় লোকদল যথাক্রমে ছয় এবং আটটি আসন পেয়েছে।
খবরে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় মেয়াদে যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারেন হোলির পরে ১৮ মার্চ।
এটা তো বলাই যায়, রাজ্যের জনগণ শুধুমাত্র বিজেপির নীতির প্রতি আস্থা প্রকাশ করেনি, বরং এটিকে একটি সুইপিং ম্যান্ডেট দিয়ে আবারও সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করেছে। রাজ্যে মহামারি বিপর্যয় ও ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও কট্টরপন্থি হিন্দু সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ দেশটির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলকে একটি বিশাল নির্বাচনে জয় এনে দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে তার পরিধিতে ২২ কোটিরও বেশি লোকের বাসস্থান এবং সেখানের তিনি মুখ্যমন্ত্রী। আর তার এই প্রত্যাবর্তন জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং হিন্দু গোষ্ঠীর কিছু নেতাদের মধ্যে এই ধারণাকে শক্তিশালী করেছে যে তিনি হয়তো একদিন প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন। প্রমোদ কুমার মল বলে একজন বিজেপি নেতা তো বলেই রেখেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবসরের পর সেই চেয়ারে বসার জন্য যোগী আদিত্যনাথই সেরা মানুষ।
নুরুল ইসলাম বাবুল: শিক্ষক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক