সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৬৬টি কোম্পানির বেশিরভাগের শেয়ারদর একদিনে যত কমা সম্ভব, কমেছে প্রায় ততটাই।
গত বছর করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর প্রতিটি শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দেয়া হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে লকডাউনের মধ্যে ৬৬টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হয়।
বুধবার হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত আসার পর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কী হয় তা নিয়ে শেয়ারধারীদের মধ্যে উদ্বেগ ছিল।
যে ভীতি ছিল, সেটাই সত্য হয়েছে। সকাল ১০টায় লেনদেনের শুরুতেই এসব কোম্পানির শেয়ারদর সর্বোচ্চ পরিমাণে কমে যায়।
আর এই বিষয়টি লকডাউন চলাকালে বাজারে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করল। লকডাউনের আগের দিন প্রায় দুইশ পয়েন্ট সূচক কমে গেলেও লকডাউনের তিন দিনে এর চেয়ে বেশি সূচক বৃদ্ধিতে যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল, সেটি কার্যত ভেস্তে গেছে। নতুন করে আতঙ্ক তৈরির পর এক দিনে সূচক পড়ল ৮২ পয়েন্ট।
পুঁজিবাজারে প্রতিটি শেয়ারের দর একদিনে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে, তাকে বলা হয় সার্কিট ব্রেকার। ১০০ টাকার নিচে দাম যেগুলোর, সেগুলো সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তে বা কমতে পারে। তবে প্রতিটির দাম সর্বনিম্ন ১০ পয়সা হিসাবে বাড়ে বা কমে। একে বলে ড্রিপ। এই ড্রিপের হিসাবের পয়েন্টের হিসাবে কিছুটা কম কমতে পারে।
সাফকো স্পিনিং মিলের ফ্লোর প্রাইস ছিল ১১ টাকা ২০ টাকা। এক টাকা ১০ পয়সা দর হারিয়ে লেনদেন হয়েছে ১০ টাকা ১০ পয়সায়।
‘বি‘ ক্যাটাগরির সোনারগাঁও টেক্সটাইলের ফ্লোর প্রাইস ছিল ২৪ টাকা ৫০ পয়সা। সর্বোচ্চ দুই টাকা ৪০ পয়সা কমে দর দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা ১০ পয়সা।
ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়ার পর এম এল ডাইংলে শেয়ার প্রতি দর কমেছে ১০ শতাংশ। কোম্পানিটির ফ্লোর প্রাইস ছিল ৫০ টাকা। সেখানে থেকে দর কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকায়।
এএফসি এ্যাগ্রোর ফ্লোর প্রাইস নির্ধারন করা হয়েছিল ১৭ টাকা। এক টাকা ৭০ পয়সা দাম কমে এখন দর দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সা।
সেন্ট্রাল ফার্মার সর্বনিম্ম দর নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২ টাকা। ১০ শতাংশ কমে দর দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৮০ পয়সা।
নাহি অ্যালোমিনিয়ামের ফ্লোর প্রাইস ছিল ৪৭ টাকা ১০ পয়সা। সেখান থেকে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ দর কমেছে হয়েছে ৪২ টাকা ৪০ পয়সা।
মিউচ্যুয়াল ট্রান্ট ব্যাংকের ফ্লোর প্রাইস ছিল ২৪ টাকা ১০ পয়সা। ২ টাকা ৪০ পয়সা কমে দাম হয়েছে ২১ টাকা ৭০ পয়সা।
আলিফ ইন্ডাস্ট্রির শেয়ার প্রতি দর কমেছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। কোম্পানিটির ফ্লোর প্রাইস ছিল ২৬ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে দর কমে হয়েছৈ ২৩ টাকা ৬০ পয়সা।
ইয়াকিন পলিমার শেয়ার প্রতি দর কমেছে ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। ১১ টাকা ১০ পয়সা ফ্লোর প্রাইস থেকে দর কমে দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা।
ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের শেয়ার প্রতি দর কমেছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কোম্পানিটির ফ্লোর প্রাইস ৩৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
সিলভো ফার্মা, কাট্টালী টেক্সটাইল, সায়হাম টেক্সটাইল, জাহিন স্পিনিং, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সসহ সবকটি কয়েকটির দর অপরিবর্তিত থাকলেও বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে।
কী ছিল নির্দেশনায়
বুধবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নিয়মিত কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত হয় ৬৬ কোম্পানির ক্ষেত্রে কোনো ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারের সর্বনিম্ম কোনো দর থাকবে না।
এর ব্যাখ্যা হিসাবে বলা হয়, পুঁজিবাজারের প্রায় ১১০টি কোম্পানি সেগুলোর শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। এসব কোম্পানিতে যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। সর্বনিম্ম দরে এসব কোম্পানির শেয়ার কেউ কিনতে আগ্রহী নন।
কোম্পানিগুলোকে লেনদেনে নিয়ে আসতে ফ্লোর প্রাইস বাতিল করার কথা জানানো হয়।
কেন কমল
ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক কোম্পানি আছে সেগুলোর ফান্ডমেন্টাল বিবেচনায় ফ্লোর প্রাইস বেশি নির্ধারিত হয়েছিল, সেগুলোর প্রতি আস্থা হয়ত কমবে।’
যখন ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয় তখন কোম্পানির মৌলভিত্তি, ভবিষ্যত, আয় কত তা বিবেচনা না করে কেবল ২০২০ সালের ২২ মার্চের আগের পাঁচ দিনের পাঁচ দিনের গড় দাম হিসাব করা হয়।
পুঁজিবাজারে প্রায়ই বিভিন্ন লোকসানি কোম্পানি নিয়েও কারসাজি হয়।
এ কারণে বহু লোকসানি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস ভালো ও মৌলভিত্তি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে বেশি হয়ে যায়।
যেমন গত এক যুগে প্রতি বছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া ন্যাশনাল ব্যাংকের ফ্লোর প্রাইস ঠিক হয় ৬ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু লোকসানের কাজলে ডুবতে থাকা রেনউইক যগেশ্বরের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারিত হয়েছে ৯০০ টাকা।
দেবব্রত কুমার বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে মূলত বিনিয়োগকারীরা এসব কোম্পানির শেয়ারের প্রতি আগ্রহী হননি। তবে সবকটি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে বলে যে আর বাড়বে না সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই।’
বিএসইসির নির্দেশনা উপেক্ষিত ডিএসইতে
ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর বিভিন্ন কোম্পানি রাইট ও বোনাস শেয়ার দেয়া হলেও ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় করা হয়নি।
তবে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি একটি শেয়ারে দুটি বোনাস শেয়ার ঘোষণার পর বিএসইসি ঘোষণা দেয় ফ্লোর প্রাইস সমন্বয়ের।
সিদ্ধান্ত হয়, রেকর্ড ডেটে যে শেয়ারমূল্য থাকবে, সেটার সঙ্গে বোনাস ও রাইটের সমন্বয় হবে।
এই কোম্পানিটির রেকর্ড ডেটে দাম ছিল এক হাজার ৫৫৪ টাকা। সেই হিসাবে নতুন ফ্লোর প্রাইস ঠিক হয় ৫১৮ টাকা। কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৩০ টাকা চূড়ান্ত লভ্যাংশও দিয়েছে। কিন্তু সেটি নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হয়নি।
কিন্তু শাহজালাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। কোম্পানিটি যে ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে, সেটার পাশাপাশি শেয়ার প্রতি যে ৭০ পয়সা নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে, সেটিও হিসাব করা হয়েছে নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
মার্কেন্টাইলে ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঘটেছে আরও বিস্ময়কর ঘটনা। নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণই করা হয়নি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশনার কথা জেনে যারা দুটি ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন, তারা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর এ বিষয়ে বিএসইসির নিরবতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।