বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইসলামোফোবিয়া প্রভাব ফেলছে ভারতের কূটনীতিতে

  •    
  • ৯ জুন, ২০২২ ২২:৪৬

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক ও ‘ওয়েস্ট এশিয়া অ্যাট ওয়ার’ বইয়ের লেখক তালমিজ আহমেদ বলেন, ‘ভারতীয়রা উপসাগরীয় দেশগুলোয় একটি অরাজনৈতিক, আইন মান্যকারী এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে খ্যাতি তৈরি করেছে। যদি এই ধরনের আক্রমণাত্মক কথা চলতে থাকে, তবে উপসাগরীয় নিয়োগকর্তারা নিঃশব্দে ভারতীয়দের নিয়োগ করা থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করতে পারে।’

২০২০ সালের এপ্রিল। করোনা আতঙ্কে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। ঠিক এমন সময়ে ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ওঠে এক গুরুতর অভিযোগ। ভারতে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে দায়ী করা হয় মুসলমানদের। কারণ সরকারের বিধিনিষেধ অমান্য করে তারা একটি জনসভার আয়োজন করেছিল। দ্রুত পরিস্থিতি মোড় নেয় ইসলামোফোবিয়ায়।

শত বছরের ঐহিত্য মেনে তাবলিগ-জামাতের লোকজন দিল্লিতে ওই সমাবেশ করেছিল। এতে অংশ নিয়েছিল দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মুসলিম। নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার এটিকে ‘সুপার-স্পেডার ইভেন্ট’ বলে অভিহিত করেন।

ইসলাম-বিদ্বেষে ভরে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। ইসলামোফোবিক মেমস এবং হ্যাশট্যাগগুলোয় ছড়ানো হতে থাকে ভারতে করোনা ছড়ানোর জন্য ওই সমাবেশ দায়ী। পিছিয়ে ছিল না সংবাদমাধ্যমগুলোও। ‘করোনা জিহাদ থেকে দেশকে বাঁচান’-এর মতো উসকানিমূলক শিরোনাম প্রচার করতে থাকে তারা।

লকডাউন নীতিমালা লঙ্ঘনের জন্য সমাবেশে অংশ নেয়া অন্তত এক হাজার মানুষকে অভিযুক্ত করে ভারত সরকার। আট মাস পর আটক শেষ ব্যক্তি বেকসুর খালাস পেয়েছিল আদালতে। বিচারক জানিয়েছিলেন, সরকারের নির্দেশে ‘বিদ্বেষপূর্ণভাবে বিচার করা হয়েছে’

ওই সমাবেশে অংশ নেয়াদের বেশির ভাগই এসেছিল ভারতের অন্যতম ব্যবসায়িক অংশীদার ইন্দোনেশিয়া থেকে। আঞ্চলিক শীর্ষ বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করে ইন্দোনেশিয়া সরকার। দেশটির আইনপ্রণেতারা অভিযোগ করেন, বিতর্কটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমানদের কলঙ্কিত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

সাবেক এক ভারতীয় কূটনীতিক সে সময় বলেছিলেন, এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর ‘বহিরাগতকরণ’-এর একটি উদাহরণ।

মহানবী মুহম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিজেপির দুই জ্যেষ্ঠ সদস্যের আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে ভারতের চলমান কূটনৈতিক আগুন প্রথমবার নয়। প্রধানমন্ত্রী মোদির দল বা সরকার কথিত ইসলামোফোবিয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দার সম্মুখীন হয়েছে আগেও।

দুই বছর আগে বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য এক বিতর্কের জন্ম দেন। আরব নারীদের নিয়ে ২০১৫ সালের তার একটি টুইট ফের আলোচনায় আসে। দুবাই ও কুয়েতের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, আইনজীবীরা তার মন্তব্যের কড়া নিন্দা জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সূর্য টুইটটি মুছে ফেলেছিলেন।

কেবল এটা না, ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর আরেকটি মন্তব্য ঝড় তুলেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকেছে তারা দেশকে ‘পোকার মতো’ খেয়ে ফেলছে।’

এই মন্তব্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ঝড় তুলেছিল। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী অমিত শাহের মন্তব্যকে ‘অবাঞ্ছিত এবং অজ্ঞাত’ বলে বর্ণনা করেন। একজন বাংলাদেশি কলামিস্ট লেখেন, “অমিত শাহের ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘৃণামূলক, অপমানজনক মন্তব্য করার ইতিহাস দীর্ঘ।”

গত এক বছরে ভারতের ২০০ মিলিয়ন মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিন্দু কট্টরপন্থি নেতাদের ঘৃণামূলক বক্তব্যের সুনামিতে ভারত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে হিন্দুদের অস্ত্র ধরতে বলেছে; মুসলমানদের গণহত্যার কথা বলেছে।

অতীতে ডানপন্থিরা তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিল। ভিত্তিহীন এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বলা হয়, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে। এর প্রভাবে হিন্দু জনতা সন্দেহভাজন মুসলিম গরু পাচারকারীদের মারধর শুরু করে, সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন ব্যবসা বর্জনের দাবি ওঠে জোরেশোরে।

নারী মুসলিম সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীরা ট্রোলড হয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রচার হতে থাকে মুসলিম নারীদের ভুয়া অনলাইন নিলামে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে। পার্টিজান নিউজ নেটওয়ার্কগুলো তীক্ষ্ণ টকশো চলাকালীন অংশগ্রহণকারীদের চরম অবস্থান নিতে উত্তেজিত করে আগুনে ইন্ধনও যোগ করেছে।

গত ডিসেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ আনেন হিন্দু নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

মোদি সরকার এসব ঘটনায় নীরব ছিল। এতে প্রশ্রয় পেতে থাকে উদ্রবাদীরা। সরকারের এই অবস্থান অনলাইনে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়াতে সাধারণ হিন্দুদের উৎসাহিত করেছে বলে মনে করা হয়।

দুবাইয়ের একটি হোটেলের জনপ্রিয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত শেফকে ইসলামবিরোধী টুইটের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। দুবাইয়ে বাসকারী ভারতীয়রা যখন ২০২০ সালে তাবলিগ- জামাতবিরোধী টুইট করা শুরু করে, তখন ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কে থাকা একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী টুইটে জানিয়েছিলেন, ‘কেউ যদি সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রকাশ্যে বর্ণবাদী এবং বৈষম্যমূলক মন্তব্য করে, তবে তাকে জরিমানা করা হবে এবং দেশ ছাড়তে হবে।’

মহানবীকে নিয়ে সাম্প্রতিক আপত্তিকর মন্তব্যের পর সৌদি আরব, ইরান, কাতারসহ ১৫টি দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক তালমিজ আহমেদ বলেন, ‘নবীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করা স্পষ্টতই “লাল রেখা অতিক্রম করা”।

নরেন্দ্র মোদি ওই মন্তব্যের জেরে দলের মুখপাত্রকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। ধর্মগুরু প্রতাপ ভানু মেহতা বলেন, ‘দায়মুক্তির সঙ্গে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা এবং সরকারি অনুমোদন দিয়ে ঘৃণাত্মক বক্তৃতায় ভারতের বৈশ্বিক খ্যাতিতে প্রভাব ফেলবে।’

তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেক বিজেপি নেতা বিশ্বাস করেন, ক্ষোভ শিগগিরই কমে যাবে এবং যথারীতি বাণিজ্য হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেন। ছবি: এএফপি

উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের পুরোনো ও গভীর সম্পর্ক। প্রায় ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ভারতীয় উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) অন্তর্গত ছয়টি উপসাগরীয় দেশে কাজ করে, যা পাকিস্তানিদের দ্বিগুণেরও বেশি।

ভারতীয়রা এই প্রতিটি দেশে বড় পরিসরে প্রবাসী সম্প্রদায় গঠন করে। তারা প্রতি বছর ৩৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। যার ওপর নির্ভর করে ৪০ মিলিয়ন পরিবার।

ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ। ভারত এবং জিসিসি দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলারের। সৌদি আরবের পরই ভারতে তেল রপ্তানিকারক দেশ ইরাক। ভারতের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশের বেশি আসে কাতার থেকে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ‘শক্তি নিরাপত্তা, অভিবাসী হিসেবে মানুষের কর্মসংস্থান এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ভিত্তিতে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের দারুণ সম্পর্ক বিদ্যমান।’

তবে আত্মতুষ্ট হতে পারে না ভারত। বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবেও নিতে পারে না। সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক ও ‘ওয়েস্ট এশিয়া অ্যাট ওয়ার’ বইয়ের লেখক তালমিজ আহমেদ বলেন, ‘ ভারতীয়রা এই দেশগুলোয় একটি অরাজনৈতিক, আইন মান্যকারী এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে খ্যাতি তৈরি করেছে। যদি এই ধরনের আক্রমণাত্মক কথা চলতে থাকে, তবে উপসাগরীয় নিয়োগকর্তারা নিঃশব্দে ভারতীয়দের নিয়োগ করা থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করতে পারে।’

এ বিভাগের আরো খবর