১৭ মার্চ থেকে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আগেই। এ বছর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে মুজিববর্ষ উদযাপনের ক্ষণগণনা ও মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যে বিজয়ের আলোকবর্তিকা জাতির পিতা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, সে মশাল নিয়েই আমরা আগামী দিনে চলতে চাই।’
কিন্তু কী সেই মশাল, যা বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন? সেই মশালের নাম মানুষ। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়জুড়ে ছিল মানুষ। সারা জীবনের রাজনীতিতে তিনি চেয়েছিলেন মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ। যে শক্তির জাগরণে মানুষ উত্তীর্ণ হয় পূর্ণতার দিকে। সুপ্ত-নিদ্রিত মানুষকে জাগিয়ে, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। মানবজীবনের সবচেয়ে বড় অলঙ্কার আত্মবিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি উদ্যমহীন মানুষকে আত্মশক্তিতে ভরপুর করে তুলতে চেয়েছিলেন। দুর্বলকেও দিয়েছিলেন প্রেরণা ও উজ্জীবনের স্বপ্ন।
মুজিববর্ষ পালন করতে গিয়ে আমরা এমন অসাধারণ এক মানুষকে দেখি, যার কোনো দ্বিতীয় নেই, যার পাশে কাউকে দাঁড় করানো যায় না। আর্ত-অবহেলিত অসহায় মানুষের দুঃখমোচন করার রাজনীতি করেছেন তিনি। তাদের মর্যাদাদানে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আজীবন। সত্যি বলতে কী, আমরা বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো নেতা পাইনি।
পুরো বছরটি নানা আয়োজনে পালিত হবে, আমরা বারবার ফিরে যাব ১৯৭১-এ। কিন্তু যা বাংলাদেশে আর ফেরে না, তা হলো বঙ্গবন্ধুর মতো সততা, সাহস আর মানুষের প্রতি ভালবাসার রাজনীতি। আমাদের নেতাদের চরিত্র হলো পলায়নের। বাস্তবের নির্মম আঘাত থেকে পলায়ন, নিজস্ব ব্যর্থতার কর্কশ প্রমাণ থেকে পলায়ন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বুক টান করে সব সময় সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। যেমন করে পালিয়ে যাননি ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে, তেমনই বুক পেতে দিয়েছিলেন ঘাতকের বুলেটের সামনে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট।
আজ কত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী দেশজুড়ে! কিন্তু সেই রাজনীতি কোথায়, যা বঙ্গবন্ধু করতেন? যদি প্রশ্ন করা হয় কেমন রাজনীতি করতেন জাতির জনক, তাহলে এক কথায় উত্তর হবে, ‘তিনি বড় রাজনীতি করতেন’।
তিনি সেই রাজনীতি করতেন, যে রাজনীতি ভাগাভাগির হিসাব করেনি কখনো, যে রাজনীতিতে ছিল না কেবল ক্ষমতা দখলের কৌশল। তিনি এমন রাজনীতি করেছেন, যে রাজনীতি সমাজের নানা অংশের মধ্যে, এমনকি যারা সাংঘাতিকভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ, তাদের প্রতিও কখনো বিরূপ আচরণ করে না। তার রাজনীতি ছিল বিপরীত পথের মানুষকেও এক জায়গায় আনার, একসঙ্গে পথ চলার। জাতি হিসেবে এই বড় রাজনীতিককে গ্রহণের যোগ্যতা ছিল না আমাদের। আমরা এতটাই ক্ষুদ্র যে এমন মানুষকেও সপরিবারে খুন করতে পেরেছি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত। সে সময় দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বাঙালির জীবনে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সেই প্রতীক, যার চারদিকে নিঃসহায় এক-উদ্দেশের মানুষেরা জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল না।
সেই অন্ধকার দিনগুলোতে, অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে, যে কোটি কোটি মানুষ, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক- কথাগুলো বলেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ‘মোজাফফর আহমদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা ১৯৮০, বাংলাদেশ জাতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধে।
বঙ্গবন্ধু একজন সাধারণ কর্মী থেকে নেতা হয়েছিলেন। দলের নির্দেশনা মেনেছেন, রাজপথে থেকেছেন, জেল-জুলুম সয়েছেন এবং তার জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি সততা, নিষ্ঠা আর মানুষের জন্য ভালবাসার প্রমাণ রেখেছেন। আর এ কারণেই কতিপয় উগ্রবাদী ছাড়া তার রাজনীতির সমর্থক নয়, তারাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সমীহ করে কথা বলতেন।
এমন মানুষের মৃত্যুতে তাই বাঙালির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আজও থামেনি। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশ হাঁটতে শুরু করে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ভাবধারায়। প্রশাসন থেকে রাজনীতি, সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে হয়ে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
বছর না ঘুরতেই জেলখানা থেকে সদম্ভে বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, তাদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কাল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ছিলেন, তাদের কাছে মৃত মুজিবও ছিলেন ভয়াবহ আতঙ্কের।
বিভিন্নভাবে তারা চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। খুন করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, নির্বাসনে পাঠানো হয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে, ছুঁড়ে ফেলা হয় উদারতার সব আয়োজন, ফিরিয়ে আনা হয় পাকিস্তানি ধর্মীয় উগ্রবাদকে। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চলে ধারাবাহিক নির্যাতন।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই কালো অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছে, লালন করেছে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনই সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের রাজনীতি। কিশোর বয়স থেকেই সাহসী মুজিব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মতো তার রাজনৈতিক গুরুদের জানান দিয়েছিলেন যে, এই মাটিতে শুধু নন, বিশ্বদরবারে তিনি হয়ে উঠছেন বড় রাজনীতির প্রতীক।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল বাঙালির নিজের পরাজয়। এক শ্রেণির বাঙালি এই পরাজয় নিয়ে আবার গর্বও করে। বড় নেতা হিসেবে বাঙালির এই ক্ষুদ্রতা নিয়ে আসলে বঙ্গবন্ধুর থাকাই হতো না এই দেশে। বঙ্গবন্ধু এই জাতির কাছে কিছু চাননি কখনো। দুঃখজনক হলো, আজ বাঙালির অনেকেই তার প্রতি ভক্তির প্রাবল্য দেখান, কিন্তু তারা কেউই তার মতো বড় রাজনীতির চেষ্টা করেন না।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি