প্রতি বছর বিজয় দিবসের আগের রাতে ক্যাম্পাসের সড়কে আলপনা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। ভোর পর্যন্ত তাদের এই আঁকাআঁকির কাজ চলে। এতে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও অংশ নেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনেক বছর ধরে হওয়ায় এটি তাদের প্রথায় পরিণত হয়েছে।
তবে এবারের বিজয় দিবসে বুধবার মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রীদের কাজে অংশ না নিয়ে হলে ফিরে যেতে বলে। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাতেই ক্যম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় দেয়াললিখন করেন।
কালো রংয়ের ওপর লাল কালিতে লেখেন, ‘বুয়েট শুধু ছেলেদের?’, ‘বুয়েটে মেয়ে নেই?’, ‘স্বাধীনতা? হা হা’।
প্রতিবাদী এসব দেয়াললিখনের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্রীরা হলে ফিরে না যাওয়ায় তাদের মূল ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয় প্রশাসন। এরপর ছাত্রীরা ভোররাত পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে দেয়াল লিখন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, “প্রতিবছর আমাদের ‘মুক্তির রং’ প্রোগ্রাম হয়। তবে রাতে হঠাৎ নির্দেশ আসে মুক্তির রংয়ের প্রোগ্রাম ছেলেরা করবে। মেয়েদের ক্যাম্পাস ত্যাগ করে যেতে হবে। আমরা না যাওয়ায় গার্ডরা আমাদের বের করে দেয়। যেহেতু আমাদের রাস্তায় রং করার কথা ছিল, তাই আমরাও ঝামেলা না করে বের হয়ে যাই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন রাস্তায় রং করছিলাম, তখন সনি হলের খালাদের পাঠানো হয় আমাদের নিয়ে যেতে। আমরা না যাওয়ায় সহকারী প্রাধ্যক্ষ ম্যামকে পাঠানো হয়, যেন অতিসত্বর মেয়েদের হলের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়।’
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ কী হয়েছিল যে মেয়েদের হলে চলে যাওয়ার নির্দেশ আসবে? এরপর আমরা সারারাত ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে আমাদের প্রতিবাদ দেয়ালে লিখে দিই। কারণ বিজয়ের দিনে এরকম বৈষম্যমূলক আচরণ আমরা নিতে পারিনি।’
তিনি জানান, সনি হলের ৫০ জন এবং হলে থাকে না এরকম আরও প্রায় ২০ ছাত্রী ওই সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিরুদ্ধ গাঙ্গুলী বলেন, ‘বুধবার রাত ১১টায় আমরা রংয়ের কাজ শুরু করি। তবে রাত ১টায় হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা এসে বলেন, উপাচার্য স্যারের নির্দেশ এক্ষুণি মেয়েদের হলে চলে যেতে হবে আর ছেলেরা চাইলে রং করতে পারে।
‘নিরাপত্তাকর্মীরা চলে যেতে বলার পরও ছাত্রীরা না যাওয়ায় সাবিকুন নাহার সনি হলের সহকারী প্রাধ্যক্ষ হলের বিভিন্ন স্টাফদের নিয়ে এসে মেয়েদের কনভিন্স করে হলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রাধ্যক্ষ বলার পরও যখন ছাত্রীরা যাচ্ছে না, তখন আমাদের মূল ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা পলাশী থেকে বকশীবাজারের যে সড়ক সেখানেই সারা রাত অবস্থান করে। আর এ ঘটনার প্রতিবাদে হলগুলোর বাইরের যে দেয়াল তা কালো করে সেখানে দেয়াল লিখন করা হয়।’
অনিরুদ্ধ বলেন, ‘প্রতিদিন সাধারণত মেয়েদের হল রাত ১০টা বা ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু প্রতি বছর এই দিনে সে রকম কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্রী হলে থাকে না, রং করতে এসে তারাও হলে থাকতে পারে।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘অনেক বছর ধরে আমাদের এই প্রথা চলে আসছিল। এই প্রথম আমাদের বাধা দেয়া হয়েছে। আমরা এটি মানতে পারছি না।’
হল প্রশাসনের এমন আচরণ শিক্ষার্থীদের জন্য অপমানজনক উল্লেখ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছাত্রীরা তো আর বাচ্চা না যে তাদের ধরে ধরে হলে নিয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী প্রাপ্তবয়স্ক। তাদের প্রতি বাচ্চাদের মতো আচরণ খুবই অপমানজনক।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আশরাফ বলেন, ‘গতকালের ঘটনার পর সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য স্যারের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। তবে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। বিকেলে স্যার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করেন। তখন স্যার বলেছেন, এটি ভুল বোঝাবুঝি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্রীদের হলে নিয়ে যাওয়ানোর ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা ছিল না।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার এবং ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল জাব্বারের ব্যক্তিগত সহকারী অমিত দে বলেন, ‘উপাচার্য, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক এবং উপ-উপাচার্য সুবর্ণজয়ন্তীর প্রোগ্রামে আছেন, তাই ফোন ধরছেন না।’