বান্দরবানে ১৭ ঘণ্টার ব্যবধানে তিন ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনায় ব্যাপক আলোচনায় আসে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।
এর মধ্যেই বান্দরবানের আলীকদমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি যৌথ চেকপোস্টেও হামলা চালিয়েছে সংগঠনটি। থানায়ও হামলা করেছে তারা। এরপরই সশস্ত্র এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সেনা-বিজিবি-র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেএমএফ কতটা শক্তিশালী? ব্যাংক ডাকাতি ও থানায় হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে স্নাতক করা নাথান আবার আলোচনায়। এ সংগঠনের শীর্ষ নেতা নাথাম বম এখন কোথায় তা নিয়েও চলছে আলোচনা। এসব হামলার নেপথ্যে তিনি রয়েছেন বলে ধারণা অনেকের।
নাথানকে গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ। শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বান্দরবান পরিদর্শনে যান। সেখানে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। ওই বৈঠকে নাথানের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় নাথানের ব্যাপারে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়ার বিষয়টিও উঠে আসে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নাথান লনচেও বমের হাতে গড়ে উঠেছে কুকি-চিন। ২০০৮ সালে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। পরে কয়েকবার নাম বদলে হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ, যার সশস্ত্র উইংয়ের নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ২০২২ সালে কুকি-চিনের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। গত দুই বছর ধরে বান্দরবানের ৪টি উপজেলায় নাথান বমের নেতৃত্বাধীন কুকি-চিন তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছে।
নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে ট্রেনিং দিয়ে ২০২২ সালে আলোচনায় আসে কেএনএফ। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে তারা সরে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে হঠাৎ কেএনএফের শক্তির মহড়ায় পাহাড়ের সাধারণ বম সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরপর কয়েকটি ঘটনার কারণে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি কারণ ছাড়া অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। কেএনএফের এমন কর্মকাণ্ডে তাদের সাধারণ জীবনযাপন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করেছেন অনেকে।
বম সম্প্রদায়ের অনেকে আবার কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন। কারণ, এর আগেও কেএনএফ সদস্যরা সাধারণ বম জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে অপহরণ করে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘চর’ সন্দেহে তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল। তবে হঠাৎ কেএনএফ এত শক্তি ও অস্ত্র কোথায় পেল, এ নিয়ে তাদের মধ্যেও আছে নানা প্রশ্ন।
কেএনএফ-এর দাবি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম হিসেবে প্রচার করছে অনেকে।
২০২২ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে ফেসবুকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্য দাবি করে কেএনএফ। তখনই সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করে তারা।
একই বছর পার্বত্য এলাকায় ‘জঙ্গি বিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। তখন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই অভিযানের পর কেএনএফ-এর সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না।
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জারলম বম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পাঁচ মাস আগে নাথানের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। তখন তিনি মিজোরামে অবস্থান করছেন বলে দাবি করেন। তিনি অনেক দিন ধরেই পলাতক। তবে তার গ্রুপের লোকজন পাহাড়ে আছে।
‘কেএনএফকে শান্তি আলোচনায় আনতে প্রথম দফা যে বৈঠক হয়েছিল, তার আগেই নাথানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বৈঠকে কেএনএফের পক্ষ থেকে কারা থাকবে, সেটা ঠিক করে দিয়েছিলেন নাথান। এরপর দীর্ঘদিন থেকে তিনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।’
সূত্র জানায়, বান্দরবানের রুমা সুসাং ও সিমপ্ল্যাকিংপাড়া থেকে কয়েক মাস আগে বম সম্প্রদায়ের ১২-১৫ জন তরুণী ঘর ছাড়ে। স্থানীয়দের ধারণা, কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে তারা ঘর ছেড়েছে।
বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। প্রথমত, টাকা লুট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা জাহিরের চেষ্টা।
সূত্র জানায়, আগের তুলনায় ৩-৪ গুণ সদস্য বাড়িয়ে কেএনএফ এখন আরও দুর্ধর্ষ। তাদের সক্রিয় নারী সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতি ও থানচি থানায় হামলায় সরাসরি অংশ নেয়। সংগঠনটির সশস্ত্র শাখাকে চিহ্নিত করার জন্য একাধিক টিম গঠন করেছে পুলিশ।
থানচি থানার ওসি জসিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, তাদের ধারণা থানচিতে হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানার দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পারছি তাতে আমাদের মনে হয় আশপাশের পাহাড়ে তারা আছে। তবে তাদের এমন কোনো শক্তি নেই যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে। একটা পরিস্থিতি হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবানের শান্তি আলোচনা বিষয়ে কেএনএফ-এর বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ হয়েছিল তাদের কয়েকজন ধারণা দিয়েছেন, কেএনএফ-এর সামরিক শাখার সদস্য সংখ্যা সাড়ে তিনশ থেকে চার শ’র মতো হতে পারে।
তারা ফেসবুকে জানিয়েছিল, তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে, যার নাম হেড হান্টার কমান্ডো টিম।
ওই বছরের জুলাই মাসে ফেসবুকে কেএনএফ জানায়, তাদেরে একদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর আগস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে তারাই তাদের কমান্ডো।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কেএনএফ-এর শক্তি ও সমর্থন খুব একটা আছে মনে হয় না। শুরুতেই ওদেরকে সেভাবে গুরুত্ব না দেয়ায় একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরবর্তীতে জঙ্গি ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। আবার কেএনএফ আলোচনায় আসায় হয়তো আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগেই এবারের ঘটনা ঘটেছে।’
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, ‘বান্দরবানের এলাকাগুলোতে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলেই আছে। কোথাও কোনো হামলার শঙ্কা নেই। তবে কেএনএফ নিশ্চিহ্ন করতে কিছু জায়গায় যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
‘কুকি-চিনের হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয়টি মামলা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তায় অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি, র্যাব মোতায়েন রয়েছে।’
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কেএনএফ বান্দরবানের পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে ছিল। তাদের আইনের আওতায় আনতে অভিযান চলছে।’
বুধ ও বৃহস্পতিবারের ব্যাংক ডাকাতি এবং থানায় হামলার ঘটনায় পুরো পার্বত্য অঞ্চলে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এক ধরনের আতঙ্ক মানুষের চোখেমুখে। রুমা উপজেলার বেশিরভাগ বাসিন্দার মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। অপ্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। আর কেউ বের হলেও সন্ধ্যার আগে ফিরছেন। ঘরেও লোকজন নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না।
তবে লোকজনকে আতঙ্কিত না হতে বলেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) নূরে আলম মিনা। তিনি বলেন, ‘বান্দরবানের কয়েকটি থানায় পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’