× হোম জাতীয় রাজধানী সারা দেশ অনুসন্ধান বিশেষ রাজনীতি আইন-অপরাধ ফলোআপ কৃষি বিজ্ঞান চাকরি-ক্যারিয়ার প্রযুক্তি উদ্যোগ আয়োজন ফোরাম অন্যান্য ঐতিহ্য বিনোদন সাহিত্য শিল্প ইভেন্ট উৎসব ধর্ম ট্রেন্ড রূপচর্চা টিপস ফুড অ্যান্ড ট্রাভেল সোশ্যাল মিডিয়া বিচিত্র সিটিজেন জার্নালিজম ব্যাংক পুঁজিবাজার বিমা বাজার অন্যান্য ট্রান্সজেন্ডার নারী পুরুষ নির্বাচন রেস অন্যান্য আফগানিস্তান ১৫ আগস্ট কী-কেন স্বপ্ন বাজেট আরব বিশ্ব পরিবেশ বিশ্লেষণ ইন্টারভিউ মুজিব শতবর্ষ ভিডিও যৌনতা-প্রজনন মানসিক স্বাস্থ্য অন্যান্য উদ্ভাবন প্রবাসী আফ্রিকা ক্রিকেট শারীরিক স্বাস্থ্য আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়া সিনেমা নাটক মিউজিক শোবিজ অন্যান্য ক্যাম্পাস পরীক্ষা শিক্ষক গবেষণা অন্যান্য কোভিড ১৯ ইউরোপ ব্লকচেইন ভাষান্তর অন্যান্য ফুটবল অন্যান্য পডকাস্ট বাংলা কনভার্টার নামাজের সময়সূচি আমাদের সম্পর্কে যোগাযোগ প্রাইভেসি পলিসি

বিশ্লেষণ
দখলদার ইসরায়েলের আগ্রাসন ও বাংলাদেশের অবস্থান
google_news print-icon

দখলদার ইসরায়েলের আগ্রাসন ও বাংলাদেশের অবস্থান

দখলদার-ইসরায়েলের-আগ্রাসন-ও-বাংলাদেশের-অবস্থান
আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা এবং সীমান্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে আবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। পাঁচ দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এই প্রথমবারের মতো জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে।

যে ভূখণ্ডকে ইসরায়েল নামে ডাকা হয়, তা আসলে ইসরায়েলের ভূখণ্ড নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক ভূমিদস্যু ইসরায়েল অবৈধ দখলদার।

১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইল আয়তনের ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হলে ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধিকারভুক্ত হয়। ১৯২২ সালে জাতিসংঘ তার গঠনতন্ত্রের ২২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফিলিস্তিন প্রশাসন পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে সাময়িকভাবে কর্তৃত্ব বা ম্যান্ডেট প্রদান করে। উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনের প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে ওঠার পর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় সত্তা গঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজিত রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে অধিকৃত কিছু ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সাময়িক শাসনের দায়িত্বও জাতিসংঘের কোনো কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করা হয়। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের আগে অন্তর্বর্তীকাল এসব অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত কোনো রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজিত তুরস্ক, জার্মানি, ইতালি ও জাপানের কাছ থেকে অধিকৃত যেসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের অধীনে প্রদান করা হয়েছিল, একে একে সবাই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা দেয় ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে।

ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ রক্ষক ভক্ষককে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটেন ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেও ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র গঠনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ইহুদি ছিল না। অল্প কয়েক হাজার ইহুদির বাস ছিল তৎকালীন ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে তাই নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিদের নিয়ে এসে ফিলিস্তিনে জড়ো করতে থাকে। ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুসলমানদের ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করতে ব্রিটিশ সরকার ইহুদি সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেয়ে ইহুদিরা বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। এদের মধ্যে ভয়ংকর সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং; যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে৷ আর এই সুযোগে ফিলিস্তিনিদের জমিজমা ইহুদিরা দখল করে নেয়।

১৯২২ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি ছিল মাত্র ১২ শতাংশ, ১৯৩১ সালে তা হয় ২৩ শতাংশ, আর ১৯৪৭-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ শতাংশে। ইহুদিদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পেলে ব্রিটিশ সরকার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ২ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার নবগঠিত জাতিসংঘকে চিঠি দেয় পরবর্তী সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিন ইস্যুকে এজেন্ডাভুক্ত করে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য সুপারিশ গ্রহণ করতে। অথচ এ বিষয়ে জাতিসংঘের কিছুই করণীয় ছিল না। ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্ব ছিল জাতিসংঘ প্রদত্ত ম্যান্ডেটের শর্ত অনুযায়ী তার কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করা। চিঠি পেয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একই বছরের ১৫ মে ১০৬ নং সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ফিলিস্তিন বিষয়ে অনুসন্ধান করে উপযুক্ত সুপারিশমালা প্রণয়ণের জন্য U.N. Special Committee on Palestine (UNSCOP) গঠন করে।

পক্ষপাতদুষ্ট UNSCOP ১৯৪৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত তার রিপোর্টে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে ইহুদি ও মুসলমানদের জন্য দুটি রাষ্ট্র অথবা এক রাষ্ট্রের অধীনে দুই সম্প্রদায়ের জন্য দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। ফিলিস্তিনে মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ আরব আর ৩৩ শতাংশ ছিল ইহুদি। মোট ভূমির ৮৫ শতাংশের মালিক আরবরা আর ৭ শতাংশের মালিক ছিল ইহুদিরা। আরবদের নিয়ন্ত্রণে ৮৫ শতাংশ ভূমি থাকা সত্ত্বেও ৪৫ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে আরব রাষ্ট্র আর ৭ শতাংশের মালিক ইহুদিদের জন্য ৫৫ শতাংশ নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করার সুপারিশ করে UNSCOP।

প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি এই UNSCOP-ই ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে তাদের রাষ্ট্র কেড়ে নেয়া ও ফিলিস্তিন সমস্যা সৃষ্টির প্রধান অভিযুক্ত। UNSCOP রিপোর্টের সুপারিশের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে ব্রিটিশ সরকার বিবৃতি দেয়। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে UNSCOP রিপোর্টের সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে বলা হয় ফিলিস্তিনের কোনো বিভক্তি কিংবা ইহুদি সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো বিশেষ অধিকার সৃষ্টি করা হলে আরবরা সম্ভাব্য সব উপায়ে তা প্রতিহত করবে। আরবরা ঘোষণা করে ম্যান্ডেটের বিধান অনুযায়ী সমগ্র ফিলিস্তিন নিয়ে আরব রাষ্ট্র গঠিত হবে, যেখানে সংখালঘু সব সম্প্রদায়ের মানবাধিকার, স্বাধীনতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও পবিত্র স্থানগুলোয় সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হবে। এমতাবস্থায় সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন সমস্যার সঙ্গে জড়িত আইনগত বিষয়াবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য Ad Hoc Committee on the Palestinian Question গঠন করে। অ্যাডহক কমিটি ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর তার প্রতিবেদন সাধারণ পরিষদে জমা দেয়। কমিটি স্পষ্ট করে বলে যে, ফিলিস্তিনে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে UNSCOP রিপোর্টে যে যুক্তি উল্লেখ করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আইন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা সমর্থনযোগ্য নয়। বরং, League of Nations কর্তৃক ফিলিস্তিনের ওপর ব্রিটেনকে দেয়া ম্যান্ডেট অবসান হলে এবং ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তর হতে বাধা নেই। কেবল ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরই ম্যান্ডেটের উদ্দেশ্যের যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে ও League of Nations-এর সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

অ্যাডহক কমিটি আরও বলে যে, ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ছাড়া সাধারণ পরিষদের আর কোনো সুপারিশ করার এখতিয়ার নেই। পর্যবেক্ষণে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা জাতিসংঘ সনদের নীতিমালার পরিপন্থি এবং নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। কমিটির পর্যবেক্ষণে জোর দিয়ে বলা হয়, ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ সরকার নির্ধারণ করার ও একটি রাষ্ট্র ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গঠন করার এখতিয়ার কেবল ফিলিস্তিনের জনগণের।

অ্যাডহক কমিটি তার সুপারিশে আরও বলে, ফিলিস্তিন নিয়ে জাতিসংঘে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে সাধারণ পরিষদের এজেন্ডা থেকে বাদ দেয়া সমীচীন হবে। এরপরও এ বিষয় নিয়ে কোনো বিরোধ হলে তা আন্তর্জাতিক আদালতের উপদেশমূলক মতামতের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, আরব রাষ্ট্রসমূহও বারবার ফিলিস্তিন ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রেরণের দাবি করে আসছিল।

সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক আদালতে অভিমতের জন্য না পাঠিয়ে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ১৮১ নং সিদ্ধান্তে UNSCOP-এর সুপারিশ মোতাবেক ফিলিস্তিন ভাগ করে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নিরাপত্তা পরিষদকে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। নিরপত্তা পরিষদের সদস্যরা এ নিয়ে চরম বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। নিরপত্তা পরিষদের সামনে প্রশ্ন দাঁড়ায়, কোনো রাষ্ট্রের জনগণের সম্মতি ছাড়া ওই রাষ্ট্রকে ভাগ করার, বিধিবিধান তৈরি করার, কোনো চুক্তি চাপিয়ে দেয়ার এখতিয়ার সাধারণ পরিষদের আছে কি না? তা ছাড়া সাধারণ পরিষদ নিরাপত্তা পরিষদকে যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করেছে, তা জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের কাজের অন্তর্ভুক্ত কি না? বিতর্ক শেষে ঐকমত্য হয়, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদ কেবল তখনই সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, যখন আগ্রাসন বা অন্য কোনো কারণে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বা হুমকির মুখে পড়ে। রাষ্ট্র বিভাজনের পরিকল্পনা যা পক্ষগণ প্রত্যাখ্যান করেছে তা নিজেই শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদ কখনোই এমন কাজে যুক্ত হতে পারে না। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি চীনা প্রতিনিধি মত দেন, নিরাপত্তা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্য। এটি খুবই দুঃখজনক হবে, রাষ্ট্রভাগের নাম করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে জাতিসংঘ নিজেই যদি যুদ্ধের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৫ মে ১৯৪৮ ফিলিস্তিনের ওপর তাদের ম্যান্ডেট অবসানের ঘোষণা দেয়। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় দ্রুত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তাব পাস করে নিরাপত্তা পরিষদ। উদ্বেগাকুল এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৪ মে ১৯৪৮ ইহুদিরা একতরফাভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। তাদের ঘোষণার ভিত্তি হিসেবে সাধারণ পরিষদের ১৮১ নং সিদ্ধান্তকে উল্লেখ করে যেখানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কথা রয়েছে। আশপাশের আরব দেশগুলো ইসরায়েলের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে হামলা চালালে ইসরাইল, ফিলিনিনের পুরোটাই দখল করে নেয় (শুধু গাজা মিসরের দখলে, এবং পশ্চিম তীর জর্ডানের দখলে ছিল)।

আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমাগত তিক্ততা এবং সীমান্তে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে আবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। পাঁচ দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এই প্রথমবারের মতো জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে।

সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার যত আলোচনা পাঁচ যুগ ধরে হয়ে এসেছে, সেগুলোতে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে ১৯৬৭ সালের আগের অবস্থানে ইসরায়েলের পিছু হটার কথা বলা হয়েছে।

ইসরায়েল একের পর এক জাতিসংঘের প্রস্তাব উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে দখল করা ফিলিস্তিনি ও আরব ভূমি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এরপর ১৯৮০ সালে ইসরায়েল আবার পূর্ব জেরুজালেমের দখলী অংশকে ইসরায়েল সম্প্রসারিত অঞ্চল হিসেবে অধিগ্রহণের কথা ঘোষণা করে। ওই বেআইনি অধিগ্রহণকে নিরাপত্তা পরিষদ (৩০ জুন ১৯৮০, প্রস্তাব ৪৭৬) বাতিল বলে ঘোষণা করে। ইসরায়েলই হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র, যার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশ্বশক্তিগুলো নির্বিকার। ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ৫৬ শতাংশ ভূমির বাইরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রর জন্য প্রস্তাবিত এলাকায় নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ শুরু করে। ইতিমধ্যে সাবেক ফিলিস্তিনের প্রায় ৮০ শতাংশ দখল করে নিয়েছে।

পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকে, সেখানে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপনকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে ওঠে। সম্প্রতি পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ হতে কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি ফিলিস্তিনিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। পবিত্র রমজানের শুরু থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তখন প্রায় প্রতিরাতেই ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ চলছিল। এরই পরিণতিতে ইসরায়েল বর্বর আগ্রাসন শুরু করে।

অভ্যুদয়ের পরই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলকে দখলদার হিসেবে অভিহিত করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আরব রাষ্ট্রগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তখনও ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরবদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে পিছপা হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইসরায়েলের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। Jewish Telegraphic Agency (JTA)-এর ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি Daily News Bulletin-এ `Israel Recognizes Bangladesh’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র কয়েক সপ্তাহের (একটি সূত্রমতে ৩৩ দিনের) মাথায় ইসরায়েল প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সংবাদে প্রকাশ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে ইসরায়েল এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বরাবর একটি চিঠি পাঠায়। একাত্তরের ২ জুলাই ইসরায়েলি পার্লামেন্ট বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া ধ্বংসলীলায় নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। এমনকি ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের অনুরোধে ইসরায়েলি রেডক্রস বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ওষুধ, কাপড় ও খাবার পাঠায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় লাভের পর প্রথম যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ইসরায়েল তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে। নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই প্রয়োজন ছিল। তদুপরি দুটি যুদ্ধে আরব বিশ্বকে পরাজিত করে ইসরায়েল বেশ শক্তিশালী রাষ্ট্র। ইসরায়েলের সঙ্গে বিশ্বের অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের দহরমমহরম। তবু বাংলাদেশে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি জোরালো সমর্থন অব্যাহত রাখতে এবং মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি হোক এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে ইসরায়েলের স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি। ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনকে সমর্থন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অতিগুরুত্বপূর্ণ নীতি।

১৯৬৭ সালে নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে সমর্থন করে বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে মেডিক্যাল টিম ও ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহায়তা করে। ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনের সময় ইয়াসির আরাফাত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তার প্রথম ভাষণে, ১৯৭৪ সালে ওআইসির দ্বিতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৭৩ সালে চতুর্থ ন্যাম সম্মেলনে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ঢাকায় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পিএলওর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। বাংলাদেশ সরকার ফিলিস্তিনি ছাত্রদের বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনের সামরিক সদস্যদের বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সামরিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ যেমন ইসরায়েলের স্বীকৃতি গ্রহণ করেনি তেমনি গত ৫০ বছরে ইসরায়েলকেও বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি। বাংলাদেশের পাসপোর্টে স্পষ্টভাবে উৎকীর্ণ রয়েছে, ‘This Passport is valid for all countries of the world except Israel.’ উপরন্তু, বাংলাদেশি নাগরিকদের ইসরায়েল ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সব রকম বাণিজ্য (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ক্রমাগত ও জোরালো সমর্থক এবং ইসরায়েলের দখলদারির বিরোধিতাকারী। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলের চলমান বর্বরোচিত আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী লিখিতভাবে প্রতিবাদ করেছেন। ইসরায়েলি হামলায় হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়ে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসকে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে নিরীহ মুসলমান এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার গভীর দুঃখ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দার পাশাপাশি হামলার শিকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনসহ সারা বিশ্বের যেসব স্থানে এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো বন্ধে টেকসই ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন।

শেখ জাররাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরাইলের দখলের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে সেই এলাকা দখল করে ইসরাইলি বাহিনী মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন করেছে। চিঠিতে ফিলিস্তিনের রাজধানী পূর্ব জেরুজালেমসহ ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ওপর ভিত্তি করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ বিশ্বাস করে সংঘাত, সহিংসতা, দখলদারি ফিলিস্তিন বা মুসলিম সম্পর্কিত বিষয় নয়; বিষয়টি মানবাধিকার ও মানবিকতার। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত মানুষকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ও দ্বিরাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে একটি স্বাধীন ও টেকসই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবির পক্ষে উচ্চকিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং জাতিসংঘ প্রস্তাব, আরব পিস ইনিশিয়েটিভ ও কোয়ার্টেট রোডম্যাপের আলোকে স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকটের একটি টেকসই এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।

অনেক মুসলিম দেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে কিংবা গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক তৈরি করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বাসভঙ্গ কিংবা কোনো ভান-ভনিতার আশ্রয় নেয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ইসরায়েলি দখলদারি ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অটল রয়েছে।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন:
ইতিহাস সৃষ্টি করা দিন
বিশ্বের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক
শেখ হাসিনার প্রত্যার্বতনে গণতন্ত্র প্রবহমান
শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে পরাজিত অপশক্তি
স্বপ্ন ও সাহসের প্রতিভূ

মন্তব্য

আরও পড়ুন

বিশ্লেষণ
Tamim Iqbals unique treatment of the golden age of Islam and Islam

তামিম ইকবালের সুচিকিৎসা ও ইসলামের স্বর্ণযুগের অনন্য চিকিৎসাব্যবস্থা

তামিম ইকবালের সুচিকিৎসা ও ইসলামের স্বর্ণযুগের অনন্য চিকিৎসাব্যবস্থা ইসলামের স্বর্ণযুগের চিকিৎসাকর্মী। ছবি: দ্য রিভিউ অব রিলিজিয়নস
১২৮৪ সালে মিসরের কায়রোতে নির্মিত এই ‘মানসুরি হাসপাতাল’ ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এখানে চারটি বড় আঙিনার কেন্দ্রে জলপ্রপাত ছিল, রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড, বহির্বিভাগ, ওষুধ বিতরণ কেন্দ্র এবং শিক্ষার্থীদের জন্য লেকচার হল ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকরা শুধু রোগীদের চিকিৎসাই করতেন না, বরং প্রয়োজনে তাদের বাড়িতেও গিয়ে সেবা দিতেন। বিশেষত, জ্বর ওয়ার্ডগুলোকে জলপ্রপাতের মাধ্যমে ঠান্ডা রাখা হতো এবং রোগীদের বিনোদনের জন্য সংগীতশিল্পী ও গল্প বলার ব্যবস্থা ছিল।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার তামিম ইকবালের সুস্থতায় দেশবাসী যেমন চরম আনন্দ পেয়েছে, তেমনই তাদের অনেকে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। এতদিন দেশের মানুষের বিশাল অংশের একটি ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসক নেই। কিন্তু তামিম ইকবাল যখন বুকে ব্যথা অনুভব করেন, তখন দুই ঘণ্টার মধ্যেই এনজিওগ্রাম, হার্টে স্টেন্ট তথা রিং বসানোসহ সবকিছু হয়ে যায়।

তামিম দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। তাই তার চিকিৎসায় বিলম্ব হয়নি। এই যে দ্রুত গতিতে চিকিৎসাসেবা পাওয়া, সেটি তার জন্য করুণা নয়; বরং ন্যায্য পাওনা।

আকস্মিক অসুস্থতায় মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখার পর তামিমের দ্রুত চিকিৎসা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ঘটনাটি সমাজে ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্যকেও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসাপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতা এত সুন্দর বা সহজ নয়। ভর্তির ফরম পূরণ, সিরিয়ালের অপেক্ষা, হাসপাতালের করিডোরে দীর্ঘ প্রতীক্ষা—আরও কতকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতি পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এখানে উন্নত চিকিৎসা পেতে হলে আপনাকে ধনী, জনপ্রিয়ত হতে হবে অথবা আপনার ‌তদবির করার মতো লোক থাকতে হবে। যাদের সেগুলো আছে, তারা ভালো চিকিৎসা পাবে, যাদের নেই তারা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পড়বেন। ভাগ্য ভালো না হলে বেঘোরে প্রাণটা হারাবেন।

জনগণ তামিমের ঘটনা থেকে জানতে পারল বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই কথাটা ‌‘যদি’, ‘কিন্তু’ ছাড়া ভুল। বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসা আছে, কিন্তু সেটা সাধারণ জনগণের জন্য সোনার হরিণেরমতো।

আসলে এটি শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, সারা বিশ্বেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুচিকিৎসা পেতে অনেক বেগ পেতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার ৭৪৯ ডলার খরচ করতে হয় স্বাস্থ্যবিমার জন্য। দেশটিতে গত এক দশকে বিমাহীন মানুষের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ বেড়েছে, যা দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।

জানলে অনেকে আঁতকে উঠবেন যে, জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতি বছর আড়াই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় ভুল চিকিৎসায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অন্য কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। হৃদরোগ ও ক্যানসারে ভুল চিকিৎসার জন্য মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।

যদিও ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD) নামে বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণী একটি ফোরাম বলছে, আমেরিকার চেয়ে পৃথিবীর আর কোনো দেশে চিকিৎসা খাতে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় না। তবে চিকিৎসায় ব্যয়ের বেশির ভাগ অংশ সরাসরি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নয়, বরং হাসপাতাল নির্মাণ, উন্নয়ন, স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন ও ওষুধের উচ্চমূল্যের পেছনে ব্যয় হয়। ফলে জনসাধারণ স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা পান না।

আমরা যখন একুশ শতকে সামরিকভাবে প্রচণ্ড প্রভাবশালী রাষ্ট্রের এ চিত্র দেখছি, তখন শত শত বছর আগে ইসলামী ভাবধারার শাসনামলে চিকিৎসা ছিল ধনী-গরিব সবার জন্য সমান। পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডে ইসলামের সোনালি এ দিনগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবে ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে কায়রোর আল-মানসুর কালাউনের বিমারিস্তানের (হাসপাতাল) পলিসি স্টেটমেন্টটি দেখলে আপনি হয়তো ফিরে যেতে চাইবেন সেই সময়ে। চলুন দেখে নিই, কী ছিল সেই পলিসি স্টেটমেন্টে।

সেখানে বলা ছিল, ‘হাসপাতাল সকল রোগীকে-পুরুষ ও নারী- সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রাখবে। সব খরচ হাসপাতাল বহন করবে, তা সে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসুক বা নিকটবর্তী এলাকা থেকে, বাসিন্দা হোক বা বিদেশি, সবল হোক বা দুর্বল, উচ্চবিত্ত হোক বা নিম্নবিত্ত, ধনী হোক বা দরিদ্র, কর্মরত হোক বা বেকার, দৃষ্টিহীন হোক বা শারীরিকভাবে সক্ষম, মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ, শিক্ষিত বা নিরক্ষর সবাইকে সমান সেবা দেওয়া হবে।’

এখানে কোনো শর্ত বা অর্থ প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ যদি অর্থ প্রদান করতে না পারত, তাতেও কোনো আপত্তি বা ইঙ্গিত করার সুযোগ ছিল না। সম্পূর্ণ সেবাটি পরম দয়ালু আল্লাহর অনুগ্রহের মাধ্যমে প্রদান করা হতো।

১২৮৪ সালে মিসরের কায়রোতে নির্মিত এই ‘মানসুরি হাসপাতাল’ ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এখানে চারটি বড় আঙিনার কেন্দ্রে জলপ্রপাত ছিল, রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড, বহির্বিভাগ, ওষুধ বিতরণ কেন্দ্র এবং শিক্ষার্থীদের জন্য লেকচার হল ছিল।

হাসপাতালের চিকিৎসকরা শুধু রোগীদের চিকিৎসাই করতেন না, বরং প্রয়োজনে তাদের বাড়িতেও গিয়ে সেবা দিতেন। বিশেষত, জ্বর ওয়ার্ডগুলোকে জলপ্রপাতের মাধ্যমে ঠান্ডা রাখা হতো এবং রোগীদের বিনোদনের জন্য সংগীতশিল্পী ও গল্প বলার ব্যবস্থা ছিল।

বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয় হলো রোগীরা হাসপাতাল থেকে ছাড়ার সময় তাদের হাতে কিছু পরিমাণ অর্থ তুলে দেওয়া হতো, যাতে তারা আর্থিক সংকটে না পড়ে এবং কাজের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

এবার একটি চমকপ্রদ চিঠি তুলে ধরা হলো, যা দেখলে আপনি অবাক হতে পারেন। আর সেই সঙ্গে ইসলামী শাসনামলের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন।

দশম শতাব্দীতে কর্ডোবার একটি হাসপাতাল থেকে এক তরুণ ফরাসি যুবকের চিঠির কথা আমির গাফার আল-আরশদি কর্তৃক ১৯৯০ সালে বৈরুতের আল-রিসালা এস্টাবলিশমেন্ট থেকে প্রকাশিত The Islamic Scientific Supremacy শীর্ষক গ্রন্থে তুলে ধরা হয়।

চিঠিটির অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো।

‘আপনি আপনার আগের চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, আমার ওষুধের খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠাবেন। আমি বলতে চাই, আমার একেবারেই সেই টাকার প্রয়োজন নেই, কারণ এই ইসলামী হাসপাতালে চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়।

‘এ ছাড়াও এ হাসপাতালের আরেকটি চমকপ্রদ দিক হলো—যে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন, তাকে হাসপাতাল থেকে একটি নতুন পোশাক এবং পাঁচ দিনার দেওয়া হয়, যাতে তিনি বিশ্রাম ও পুনরুদ্ধারের সময় কাজ করতে বাধ্য না হন। প্রিয় বাবা, আপনি যদি আমাকে দেখতে আসতে চান, তবে আমাকে সার্জারি ও জয়েন্ট চিকিৎসা বিভাগের ওয়ার্ডে পাবেন। ফটক দিয়ে প্রবেশ করার পর দক্ষিণ কক্ষে যান, যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় বিভাগ রয়েছে। এরপর আপনি সন্ধান পাবেন বাত (জয়েন্ট) রোগ বিভাগের।’

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমার কক্ষের পাশে একটি গ্রন্থাগার এবং একটি হলঘর রয়েছে, যেখানে চিকিৎসকরা একত্রিত হয়ে অধ্যাপকদের বক্তৃতা শোনেন এবং এটি পড়াশোনার জন্যও ব্যবহৃত হয়। হাসপাতালের প্রাঙ্গণের অপর পাশে রয়েছে স্ত্রীরোগ বিভাগের ওয়ার্ড, যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। হাসপাতালের আঙিনার ডান দিকে রয়েছে বিশাল একটি হল, যেখানে সুস্থ হওয়া রোগীদের পুনরুদ্ধারের জন্য কিছুদিন রাখা হয়। এই কক্ষে একটি বিশেষ লাইব্রেরি ও কিছু বাদ্যযন্ত্রও রয়েছে।

‘প্রিয় বাবা, হাসপাতালের প্রতিটি স্থান অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিছানা ও বালিশ দামাস্কাসের সূক্ষ্ম সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকে। কম্বল তৈরি হয় নরম ও মসৃণ প্লাশ কাপড় দিয়ে। প্রতিটি কক্ষে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা আছে, যা পাইপের মাধ্যমে বিশাল একটি ঝরনার সঙ্গে সংযুক্ত। শুধু তাই নয়, প্রতিটি কক্ষে গরম রাখার জন্য চুলাও রয়েছে।

‘খাবারের ব্যবস্থা এত ভালো যে, প্রতিদিন রোগীদের জন্য মুরগির মাংস ও সবজি পরিবেশন করা হয়। এমনকি, অনেক রোগী সুস্থ হয়েও হাসপাতাল ছাড়তে চান না শুধু এখানকার সুস্বাদু খাবারের প্রতি ভালোবাসার কারণে।’

চিকিৎসাব্যবস্থাকে পুঁজিবাদ ও ইসলাম সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখে। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চিকিৎসা একটি লাভজনক ব্যবসা, অন্যদিকে ইসলাম চিকিৎসাকে মানবসেবার অংশ হিসেবে দেখে, যেখানে মুনাফার পরিবর্তে সবার জন্য সুলভ ও ন্যায়সঙ্গত চিকিৎসার ওপর জোর দেওয়া হয়।

ইসলামে চিকিৎসা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ইসলামে রাষ্ট্রকে জনগণের কল্যাণ এবং তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর প্রতি দায়িত্বশীল হতে নির্দেশ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো চিকিৎসাসেবা।

ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসাসেবা এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার নিরাময়ের উপকরণ তিনি সৃষ্টি করেননি।’ হাদিসটি ইসলামি শাসনামলে চিকিৎসাশাস্ত্রে অগ্রগতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

এ ছাড়া ‘যে ব্যক্তি মুসলিম ভাইয়ের কোনো দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ তৈরি করবেন’ এবং ‘মুসলিম একে অপরের ভাই। যদি কেউ তার ভাইয়ের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন’ ধরনের হাদিস তৎকালীন চিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত করতো সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে।

সে সময় ভুল চিকিৎসায় কারও মৃত্যু হলে তাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখা হতো, তাই দক্ষতা ছাড়া কেউ এ পেশায় আসত না, যা ভুল চিকিৎসা রোধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

চিকিৎসাসেবার মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যালোচনা নিয়ে ইবন আল-উখওয়া (Ibn al-Ukhuwa) তার গ্রন্থ মা’আলিম আল-কুরবা ফি তালাব আল-হিসবাতে কয়েকটি বিষয়টি উল্লেখ করেন।

• যদি রোগী মারা যান, তবে তার পরিবারের সদস্যরা প্রধান চিকিৎসকের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। তারা চিকিৎসকের লেখা প্রেসক্রিপশন দেখান।
• যদি প্রধান চিকিৎসক মনে করেন যে চিকিৎসক তার কাজ যথাযথভাবে করেছেন, তবে তিনি পরিবারকে জানান যে এটি একটি স্বাভাবিক মৃত্যু।
• কিন্তু যদি চিকিৎসকের অবহেলা প্রমাণিত হয়, তবে প্রধান চিকিৎসক পরিবারকে বলেন, ‘তোমাদের আত্মীয়কে ভুল চিকিৎসার কারণে হত্যা করা হয়েছে। চিকিৎসকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করো!’

এই ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতির কারণে শুধু অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরাই চিকিৎসাব্যবস্থায় কাজ করতে পারতেন।

ইসলামি সভ্যতায় আধুনিক হাসপাতালের ধারণা নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সময়েই জন্ম নিয়েছিল। ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে চিকিৎসাসেবার মূল কেন্দ্র ছিল মদিনার মসজিদ, যেখানে রোগীদের চিকিৎসার জন্য তাঁবু স্থাপন করা হতো। বিশেষ করে, গাজওয়া খন্দকের সময় নবী (সা.) আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য রুফাইদা বিনতে সাদ (রাঃ)-এর তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ তাঁবু স্থাপন করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে ইসলামী খলিফারা চিকিৎসাসেবা আরও সংগঠিত করেন এবং ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল প্রবর্তন করেন, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলে গিয়ে জনগণকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করত।

১৩০০ শতকের চিকিৎসক ও পর্যটক আবদুল লতিফ আল-বাগদাদির এক চমৎকার অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করব, যা ইসলামি শাসনামলে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নত অবস্থার চিত্র তুলে ধরে।

দামেস্কে শিক্ষকতা করা এ চিকিৎসক এক চতুর পার্সি যুবকের গল্প বলেছেন, যিনি নূরী হাসপাতালের চমৎকার খাবার ও পরিষেবার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসক তার অসুস্থতা নিয়ে সন্দেহ করলেও তাকে তিন দিন ধরে ভালো খাবার পরিবেশন করেন। চতুর্থ দিনে, চিকিৎসক তার কাছে এসে মৃদু হেসে বললেন, ‘আরবীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী, আতিথেয়তা তিন দিনের জন্য হয়ে থাকে। এখন দয়া করে বাড়ি ফিরে যান!’

পরিশেষে, তামিম ইকবাল যে দ্রুত চিকিৎসা পেয়েছেন, তা যেন কোনো ‘বিশেষাধিকার’ না হয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য হয়—সেই লক্ষ্যে এমন সমাজের জন্য কাজ করা জরুরি যে সমাজ রুফাইদা (রা.)-এর তাঁবু বা কালাউনের হাসপাতালের মতো ‘কাউকে অর্থ বা পরিচয় জিজ্ঞাসা করবে না, শুধু নিশ্চিত করবে মানবতা।’ কেননা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু মুনাফাকেন্দ্রিক, সেহেতু এ ব্যবস্থা বহাল রেখে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য সুচিকিৎসা বাস্তবতা বিবর্জিত স্বপ্ন হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন:
হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির জরায়ু কেটে ফেলার অভিযোগ
অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা বাবদ ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ সরকারের
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল: চিকিৎসক
বিদেশি চাটুকারদের উপদেষ্টা বানানো হচ্ছে: ফয়জুল করীম
চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পেলেন দুই আমেরিকান

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
What kind of reform do you want in the media? 

কেমন সংস্কার চাই গণমাধ্যমে 

কেমন সংস্কার চাই গণমাধ্যমে  সাংবাদিক আহসান কামরুল। ছবি: লেখক
কেউ যেন সাংবাদিকতার গতিপথ রুদ্ধ করতে না পারে কিংবা গতিপথ পাল্টে দিতে না পারে। গণমানুষের জন্যই হোক পেশাদার গণমাধ্যম। এটাই সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পলায়নের পরপরই দেশের সংবাদমাধ্যমের ওপর নজিরবিহীন হামলা হয়। এটি ছিল সংবাদমাধ্যমের ওপর জনতার চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

সংবাদমাধ্যমকে এমন টার্গেট করা ঠিক হয়েছে কি না, সেটি ভিন্ন আলোচনা, কিন্তু সংবাদমাধ্যম কেন এমন টার্গেট হলো? স্বৈরাচারের ১৫ বছরে মিডিয়া কি কখনও গণমাধ্যম হওয়ার চেষ্টা করেছে নাকি শুধু সংবাদমাধ্যম হিসেবেই ক্ষমতাসীনদের ফুট-ফরমায়েশ খেটেছে?

মোটাদাগে বলতে গেলে দুই-চারটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউই গণমাধ্যম হওয়ার চেষ্টা করেনি। তারা বরং নিজে থেকে যেচে গিয়ে ফুট-ফরমায়েশ খেটে গৌরববোধ করেছে। এ কারণে তারা গণমানুষ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষে রূপ নেয়ার কারণেই শেখ হাসিনার পলায়নের পর ওই ক্ষোভ গিয়ে উগড়ে পড়েছে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বিক্ষুব্ধ জনতা একের পর এক ভেঙেছে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়।

এটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসের জন্যও একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের জন্যও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে যে, ভবিষ্যতে তারা গণমাধ্যম হিসেবে সাংবাদিকতা করবে নাকি ফুট-ফরমায়েশি করে আবারও কোনো পালাবদলে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে।

শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দাবি ওঠে। গণআন্দোলনের সময়ও এটি ছিল আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি ও কমিটমেন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন হয়েছে, যার মধ্যে ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’ অন্যতম।

জুলাই গণআন্দোলনে মিডিয়ার যে ভূমিকা ছিল, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনকারীদের তৎকালীন সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ‘দুর্বৃত্ত, নাশকতাকারী’ ইত্যাদি বলেছিল বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম।

শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানের নির্দেশনা অনুযায়ী মিডিয়া এসব কাজ করেছিল বা করতে বাধ্য হয়েছিল বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে বাধ্য হওয়ার ঘটনা খুবই কম। গণভবন থেকে নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম সেই অনুযায়ী ‘হুক্কাহুয়া’ বলতে শুরু করেছিল। গণভবন থেকে পাঠানো নির্দেশনা যেন ছিল সংবাদমাধ্যমের প্রতি লজ্জাবতীর ছোঁয়া। স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই তারা গুটিসুটি হয়ে চুপসে গিয়েছিল। অথচ এটি সংবাদমাধ্যমের চরিত্রের সঙ্গে যায় না।

সাংবাদিকদের হওয়া উচিত সাহসী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। যেমনটা কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় সে সময় (৩১ জুলাই ২০২৪) বলেছিলাম: ‘‘আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত!’’

সংবাদমাধ্যম কেন লজ্জাবতীর মতো চুপসে গিয়েছিল

জুলাই গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে, সামাল দেয়ার পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। সে সময় পর্যন্তও সংবাদমাধ্যম সব পক্ষের খবরাখবর পরিবেশন করছিল। ইন্টারনেট বন্ধের পর সংবাদমাধ্যমের প্রতি নির্দেশনা জারি করেন শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান।

ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানায়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বেশ কয়েকটি মুঠোফোন মেসেজে তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নিউজ প্রচার করতে নিষেধ করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে বলেন তিনি। এরপর থেকেই পাল্টে যায় সংবাদমাধ্যমের চরিত্র। খবরে আরোপ হয় সেন্সরশিপ। সব টেলিভিশন যেন হয়ে যায় বিটিভি।

সরকার কীভাবে সফলতার সাথে আন্দোলন দমন করছে, সেটি প্রচার করাই যেন হয়ে ওঠে টেলিভিশনগুলোর খবরের মূল বিষয়বস্তু। সে সময় অবশ্য গুটিকয়েক পত্রিকা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের প্রেস সচিবের প্রেসক্রিপশন উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা নিহতের খবরাখবর প্রকাশ করতে থাকে। এ ছাড়া মানবিক কিছু প্রতিবেদনও প্রকাশ করে তারা। এর ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবশ্য সেসব মনে রাখা হয়নি।

গণমাধ্যমে কেমন সংস্কার প্রয়োজন

দেশে ৯০ পরবর্তী সময়ে করপোরেট সংবাদধ্যম পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম তার চরিত্র হারিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমে রূপ নেয়, তবে করপোরেট মালিকানায় গেলেও সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন সেভাবে হয়নি; বরং খারাপ সাংবাদিকতার চূড়ান্ত নজির আমরা দেখেছি।

গত তিন দশকে সাংবাদিকতা ডালপালা মেলে অনেকটা মহীরুহ হলেও নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচারসহ মানের দিক থেকে সবকিছুই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সেই গণবিচ্ছিন্নতার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ করে গণমাধ্যমকে প্রকৃত গণমাধ্যমে রূপান্তর করতে নিম্নোক্ত সংস্কার জরুরি।

১. নিয়োগ সংক্রান্ত সংস্কার

গণমাধ্যম এমন একটা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে যে, এখানে নিয়োগ সংক্রান্ত তেমন কোনো নীতিমালা নেই। কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠানই নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো একক নীতিমালা অনুসরণ করে না। এখানে স্বচ্ছতাও নেই। এর ফলে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছাড়াই পান দোকানদার থেকে কাঠ ব্যবসায়ী, জেলে, মাদক কারবারিসহ নানা ক্ষেত্রের দাগী অপরাধীরাও সাংবাদিকতায় ঢুকে যাচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ ছড়িয়ে পড়ছে চাটুকারিতা ও অপসাংবাদিকতা। সাংবাদিকতাকে সঠিক পথে রাখতে হলে নিয়োগ সংক্রান্ত সংস্কার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।

অন্যদিকে অনেক মিডিয়া হাউজ রয়েছে যারা সাংবাদিকদের নিয়োগপত্র দেয় না। অপেশাদার এমন আচরণ বন্ধ করে বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্র দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। পেশাদারত্বের বদলে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নিতে হবে।

(ক) শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা

দেশে অপসাংবাদিকতা বেশির ভাগই করে থাকেন যাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত এবং পারিপার্শ্বিক যোগ্যতা নেই। প্রেস কাউন্সিলসহ সাংবাদিকতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কথা বলেন। অজ্ঞাত কারণে বিষয়টিকে তারা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। অপসাংবাদিকতা রুখতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিও সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

(খ) চাকরির নিশ্চয়তা

পেশাদার সাংবাদিকতায় যারা রয়েছেন, তাদের বেশির ভাগেরই চাকরি নিয়ে এক অজানা আতঙ্ক থাকেন। কখন যেন আকস্মিক নোটিশে চাকরিহারা হতে হয়। সাংবাদিকদের চাকরি থেকে বের করে দেয়া যেন ছেলের হাতের মোয়া। এমনও অনেক সময় হয় যে, রাতে কাজ করে গিয়ে সকালে শুনতে পান যে তার চাকরি নেই।

এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। কোনো সাংবাদিককে হুটহাট নোটিশে চাকরি থেকে বের করে দেয়া যাবে না। কোনো কারণে যদি চাকরি যায়ও, সেটাও যেন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় হয়। এতে সাংবাদিকতা অপেশাদারি থেকে রক্ষা পাবে।

২. বেতন সংক্রান্ত সংস্কার

বিগত কয়েক দশকে সাংবাদিকতা পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হলেও এর সুফল পায়নি পেশাদার সাংবাদিকরা। এখনকার বাজারেও ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতনে গ্র্যাজুয়েট কর্মী খোঁজেন মিডিয়ার কর্তারা। অনেক জায়গায় আবার সেও নেই। বেতন-ভাতা দেয়া হবে বলে নিয়োগ দিলেও শেষ পর্যন্ত বেতন দেয়া হয় না। দিলেও সেটি হয় অনিয়মিত। এ কারণে অনেক সংবাদকর্মী অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাংবাদিকতা পেশার ওপর। এ জন্য নিয়মিত বেতন দেয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

নিয়মিত বেতন দেয়ার সক্ষমতা না থাকলে মিডিয়া হাউজ থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য গ্রুপ অব কোম্পানির অন্যান্য খাতে বেতন-ভাতায় সমস্যা না হলেও মিডিয়ার ক্ষেত্রে ‘দারিদ্র্যের চরম রূপ’ পরিলক্ষিত হয়।

(ক) ওয়েজ বোর্ড সংশোধন

প্রিন্ট মাধ্যমে ওয়েজ বোর্ডের বিষয় থাকলেও টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমে তারও বালাই নেই। সে জন্য কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের মনমতো অন্যায্য বেতন নির্ধারণ করেন। প্রিন্টে ওয়েজ বোর্ড থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না। কিছু কিছু জায়গায় মানা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা নেয় পত্রিকাগুলো। এ ছাড়া ওয়েজবোর্ড সংশোধন করে টেলিভিশন এবং অনলাইন গণমাধ্যম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

ওয়েজ বোর্ড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটি মনিটরিং করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি ওয়েজ বোর্ড বাতিল করে ন্যূনতম বেতনের সিস্টেম চালু করার কথা বলেছেন। সেটিও আলোচনা সাপেক্ষে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ ও কঠোর বাস্তবায়ন হতে হবে। তা না হলে আইন বা নিয়ম করে শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

৩. পেশাদারত্ব সংক্রান্ত সংস্কার

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় আমরা সংবাদমাধ্যমকে লজ্জাবতীর মতো চুপসে যেতে দেখেছি। সেটাও তবু এক ধরনের অসহায়ত্ব বলে মানা যায়। তবে বেশকিছু সংবাদমাধ্যম আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়েছিল। পেশাদারিত্বের ন্যূনতম বালাই ছিল না তাদের। জনগণের প্রতিও ছিল না কমিটমেন্ট।

স্বেচ্ছায় সেসব মিডিয়া সরকারের পক্ষ নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছে দিনের পর দিন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আমলে এভাবেই পেশাদারত্বের মুণ্ডুপাত করে গিয়েছে কথিত কিছু মিডিয়া। এ সংবাদমাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের গুজব সেল সিআরআইয়ের প্রোপাগাণ্ডা মেশিন।

বিরোধী নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল প্রচার, চরিত্র হনন থেকে শুরু করে নীতি-নৈতিকতার বলাৎকারসহ এমন কিছু নেই, যা কথিত সেই সংবাদমাধ্যমগুলো করেনি। এমন যাতে আর কখনও কেউ করতে না পারে, সে জন্য লাগাম টেনে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অপেশাদার আচরণ করে এমন কাউকে সংবাদমাধ্যমে রাখা যাবে না।

অন্যদিকে মালিকপক্ষও নানা সুবিধা পেতে নিউজরুমের কাছে অন্যায় আবদার করে থাকেন। অপেশাদার আচরণ করে তারা যাতে পার না পান, তার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এ জন্য সংবাদমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকসহ সবার দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হবে। এখানে যে যেই মতেরই হোক না কেন, শতভাগ পেশাদারত্ব বজায় রাখতে হবে।

এ ছাড়া সরকারও যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাইবার আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা জরুরি।

(ক) প্রেস কাউন্সিল শক্তিশালীকরণ

পেশাদার সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাংবাদিকরা নানাভাবে হয়রানি ও মামলা-হামলার শিকার হন। সে জন্য প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। থানা বা কোর্টে নয়, সংবাদ সংক্রান্ত সব মামলা প্রেস কাউন্সিলে করতে হবে।

প্রেস কাউন্সিলের অনুমতি বা অবগতি ব্যতীত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদ সংক্রান্ত মামলা করতে না দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে কোনো ধরনের হুমকি দেয়া বা হামলা করা হলে কঠোরভাবে প্রতিহত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. নিবন্ধন সংক্রান্ত সংস্কার

দেশে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া এখনও যেন সেই ব্রিটিশ আমলে পড়ে রয়েছে। কেউ যদি যথাযথভাবে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হয়, সে ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়াও অনলাইনভিত্তিক করা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসেও মান্ধাতার আমলের মতো এ অফিস, সে অফিস করে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়া যৌক্তিক বিষয় নয়।

এ ছাড়া নিবন্ধন পেতে হয়রানি, ঘুষ দাবিসহ সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সংবাদমাধ্যমের অবমূল্যায়ন ও হয়রানি বন্ধ করে যেকোনো এক জায়গায় সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন সংক্রান্ত বিশেষ সেল রাখা যেতে পারে।

ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে নিবন্ধনসহ সবকিছু বিশেষ সেলের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা করবেন। একই সঙ্গে কালো টাকার মালিক, অসাধু ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাফিয়া চক্রসহ অপেশাদার কাউকে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়া যাবে না। পেশাদারত্বের বদলে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ কায়েমের চেষ্টা বন্ধ করতে হলে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই হবে।

স্বৈরাচারের আগে-পরে আমরা লক্ষ করেছি যে, কোনো রিপোর্ট সরকারের পছন্দ না হলে সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়। এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। টেলিভিশন-পত্রিকার জন্য বিষয়টি কিছুটা জটিল হলেও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে খুবই সহজ। বিটিআরসি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ না হলেও এ প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে অনেক অনলাইন মিডিয়া বন্ধ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ৫৪টি অনলাইন বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি। আইন না মানলে নিবন্ধন স্থগিত ব্যতীত অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ কোনো মিডিয়াই যেন সরকার বন্ধ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরপরও সরকার কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করলে সরকারকে অন্তত ছয় মাস ওই মিডিয়ার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বহন করতে হবে।

স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো করেই সরকার যেন নিবন্ধন ইস্যু বা অন্য কোনোভাবেই মিডিয়ার ওপর কোন ধরনের হস্তক্ষেপ অথবা খবরদারি করতে না পারে, সংস্কারের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫. বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত সংস্কার

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বর্তমানে প্রিন্ট পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও বিজ্ঞাপন হার নির্ধারণ করে থাকে। এখানে অনেক শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেসব পত্রিকা দৈনিক ৫০০ কপিও ছাপা হয় না, সেসব পত্রিকা লাখ লাখ কপি ছাপানোর ভুয়া তথ্য দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে বেশি বিজ্ঞাপন রেট নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে রেট আপ-ডাউন করানো বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া ৯০০ টাকা রেট দিয়ে এখনকার সময়ে কতটুকু টিকে থাকা যায় সেটিও বিবেচ্য বিষয়।

এখনকার মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় রেট আরও অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়ানো যায় কি না, সেটিও ভেবে দেখা যেতে পারে। একই কথা রেডিও, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। সেসব মিডিয়ার জন্যও বিজ্ঞাপন নীতিমালা করা সময়ের দাবি। এ ছাড়া সামগ্রিক মিডিয়াকে শিল্প ঘোষণা করে এই শিল্পের বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া বিগত দিনে আমরা দেখেছি, সরকারের পছন্দমতো সংবাদ না করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হুমকি দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে। সংবাদের কারণে কোনো গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বন্ধ করাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এটি প্রমাণ হলে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি বা যে পদেই থাকুক না কেন পদচ্যুত করার বিধান থাকতে হবে।

৬. মিডিয়া সিটি তৈরি

বাংলাদেশে মিডিয়া হাউসগুলো পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও এটি কোনো আদর্শ পন্থা নয়। সে ক্ষেত্রে মিডিয়া সিটি তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে স্বল্পমূল্যে একই ভবনে একাধিক মিডিয়া হাউসের অফিস থাকবে। এটা উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হতে পারে।

দেশের সব সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এক এলাকায় থাকলে সব দিক থেকেই সুবিধা রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অফিস ছাড়াও সেখানে বা পাশাপাশি কোথাও সংবাদকর্মীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাও তৈরি করা যেতে পারে।

৭. ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন

সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে, নব্বই পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষার বদলে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো হয়েছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির আঁতুড়ঘর। নির্লজ্জভাবে দলীয় লেজুরবৃত্তি করাই হয়েছে তাদের একমাত্র প্রধান কাজ। সাংবাদিকতার আজকের দুর্দিনের জন্য এটিও অন্যতম কারণ।

সে জন্য সাংবাদিক ইউনিয়নকে পেশাজীবী সংগঠন করতে হবে। এই সংগঠনগুলো যাতে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার হতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এসব বিষয় ছাড়াও পেশাজীবী সাংবাদিক, মালিকপক্ষসহ পেশা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে আরও প্রয়োজনীয় বিষয় নির্ণয় করে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো সাংবাদিকতা যেন সবসময় সঠিকপথে থাকে। কোনো অশুভ শক্তি যেন সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। হোক সেটা সরকার, মালিকপক্ষ, সাংবাদিক বা যেকোনো পক্ষ থেকেই।

কেউ যেন সাংবাদিকতার গতিপথ রুদ্ধ করতে না পারে কিংবা গতিপথ পাল্টে দিতে না পারে। গণমানুষের জন্যই হোক পেশাদার গণমাধ্যম। এটাই সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক; প্রধান সমন্বয়ক, মিডিয়া মনিটর

ইমেইল: [email protected]

আরও পড়ুন:
ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি রোধে সংস্কার হতে হবে: বদিউল আলম
নির্বাচনে কারা আসবে সে সিদ্ধান্ত ইসির: বদিউল আলম
গণমাধ্যমে ওয়েজবোর্ড বন্ধ করে ন্যূনতম বেতন কাঠামো করা উচিত
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়ে হট্টগোল
কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দিচ্ছে কমিশন

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Sheikh Hasinas participation in Modis swearing in ceremony is a new dimension in India Bangladesh relations

মোদির শপথ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার যোগদান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মাত্রা

মোদির শপথ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার যোগদান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মাত্রা

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য ও শিল্পকলা-সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি এই বিষয়গুলোর প্রতি দুই দেশের মানুষের আবেগও প্রায় একইরকম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত বাংলাদেশের জন্য সরাসরি যুদ্ধে জড়ালেও তাদের সীমান্ত খোলা রেখেছিল পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের গণহত্যার শুরু থেকেই। নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে নিপীড়িত মানুষদের দীর্ঘ ৯ মাস আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছায়।

১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে।’

বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি গড়েছিলেন একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত কূটনৈতিক সম্পর্কের পথেই চলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে একে অন্যের বৈদেশিক নীতিতে দুই দেশই অগ্রাধিকার পেয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। রোববার (৯ জুন) সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদকে নিয়ে নয়াদিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, মরিশাস ও সিসিলির সরকার-রাষ্ট্রপ্রধানসহ আট হাজারের বেশি বিশিষ্টজন অংশ নেন। পরে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ভোজসভায় যোগ দেন তারা।

ভারতে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন এনডিএ জোটের প্রধান নরেন্দ্র মোদি। জওহরলাল নেহেরু ছাড়া আর কোনো প্রধানমন্ত্রী টানা তিনবার শপথ নেয়ার কৃত্বিত্ব পাননি। রোববার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত শপথ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের ৭২ সদস্যও শপথ গ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে উপস্থিত থাকলেও এতে যোগ দেননি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। মোদির পাশাপাশি তার মন্ত্রিপরিষদের ৭২ সদস্যও এ অনুষ্ঠানে শপথগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ক্যাবিনেট পদের মন্ত্রী ৩০ জন। স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী পাঁচজন।

বিজেপির পাশাপাশি মোট ১১টি জোটসঙ্গীকেও মন্ত্রীর পদ দেয়া হয়েছে। ৪৩ জন মন্ত্রী তিনবার বা তার বেশিবার এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭২ মন্ত্রীর মধ্যে ৩৯ জনই আগের সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা জমকালো এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি বিজেপির ৯৬ বছর বয়সী জ্যেষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে তার বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, বৈঠকে দুই নেতা তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এ ছাড়াও তারা পরস্পর সৌহার্দ্য বিনিময় ও অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেন।

এরপর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে তৃতীয় বিদেশি নেতা হিসেবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

বিজেপি এবার নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তাই সরকার গড়তে এনডিএর শরিক দলগুলোর ওপর পদ্মশিবিরকে অনেকাংশে নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো বিজেপি নিজের হাতেই রেখেছে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বেশ কিছু বণ্টন করা হয়েছে শরিক দল চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি, নীতীশ কুমারের জেডিইউ, চিরাগ পাসোয়ানের এলজেপি (আর), একনাথ শিন্ডের শিবসেনা, এইচডি দেবগৌড়ার জেডিএস এবং জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডির মধ্যে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান এসময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির আইটিসি মৌর্য হোটেলে মন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি নরেন্দ্র মোদি ও এনডিএ জোটকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আবারও অভিনন্দন জানান এবং প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।’

সোমবার সকালে হায়দরাবাদ হাউসে একান্ত বৈঠক করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। দুই নেতা নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম আলোচনায় বসেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আলোচনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এরই অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার ভারতে পরিকল্পিত দ্বিপক্ষীয় সফরের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। এ মাসের শেষের দিকে মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কথা রয়েছে।

রাষ্ট্রপতি ভবনে এ সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদেশের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে নরেন্দ্র মোদির নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আন্তরিক আগ্রহ ব্যক্ত করেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

হাছান মাহমুদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে এবং নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। মানুষে মানুষে সংযোগ বৃদ্ধিতে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নসহ উভয় দেশের আরও উন্নতিকল্পে আমাদের একযোগে কাজ করে যেতে হবে।’

বৈঠকে দুই নেতা বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আগামী দিনগুলোতে আরও দৃঢ় করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ড. মাহমুদ বলেন, ‘অত্যন্ত উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভারতীয় সমকক্ষকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।’

নরেন্দ্র মোদি গত ১০ বছর ধরে তার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং শেখ হাসিনাও ইতোমধ্যে ১৬ বছর ধরে তার রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন।’

একে অপরের কাছ থেকে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে অনেক বিষয় জড়িত। যেহেতু উভয় সরকার দেশ পরিচালনায় অব্যাহত রয়েছেন, সেহেতু একসঙ্গে কাজ করার কিছু সুবিধা আছে। উভয় দেশের জনগণ বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হচ্ছে, যার মধ্যে দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে যোগাযোগ রয়েছে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, ‘আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত এবং আরো গভীর হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাজ্যসভা সদস্য ও কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী ও তার ছেলে লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।

১০ জুন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইটিসি মৌর্য হোটেলে সাক্ষাৎ করেন তারা। এসময় সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও উপস্থিত ছিলেন।

হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে একান্তে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই সাক্ষাতের পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের ইউনিয়ন মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠক হয়।

বৈঠক দুটির বিষয়ে পরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের ইউনিয়ন মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকটিও ‘হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল’ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে এস জয়শঙ্করের আন্তরিকতার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পুনরায় মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানান এবং একসঙ্গে কাজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।’

এ মাসের শেষ দিকে আবার ভারত সফর করবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সফরের আগে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠনে শেখ হাসিনার অংশ নেয়া এবং মোদির সঙ্গে আলাদা বৈঠকের আলাদা গুরুত্ব আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

তাদের কথায়, এটা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরই ইঙ্গিত। সেটা বাংলাদেশের নির্বাচনের আগেও দেখা গিয়েছে। সামনেও দেখা যাবে।

তবে তারা মনে করেন, এর ফলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে বা বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু সমধানে কতটা কাজে আসে তা ভবিষ্যৎ বলবে।

ভারতে সরকার পরিবর্তন হলে সাধারণত তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন পরিবর্তন হয় না। আর ভারতে তো ওই অর্থে সরকার পরিবর্তন হয়নি। মোদিই আবার ক্ষমতায়। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে ভারতে একটা সাধারণ কনসেন্সাস আছে। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে সেটা আরও নির্ধারিত। দলের পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আসে না। মানুষের প্রত্যাশা বা চাহিদার ভিত্তিতে হয়তো কোনো জিনিস হাইলাইটেড হতে পারে।

আসলে দুই দেশের কোনো দেশেই সরকার পরিবর্তন হয়নি। ওখানে হয়তো জোট থেকে কয়েকজন মন্ত্রী হয়েছেন। তাতে তো আর বিরাট কোনো পরিবর্তন হয়ে যাবে না। দুই দেশের সম্পর্ক যেরকম আছে সেরকমই থাকবে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। আওয়ামী লীগের এক টার্ম তো ভারতে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় এলেন, তখন তো অনেকে ভেবেছিল, মোদি ক্ষমতায় এসেছেন, আওয়ামী লীগের অনেক অসুবিধা হবে। কোনো অসুবিধা তো হয়নি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকে। কারণ এই সম্পর্ক অনেক পুরোনো। এই সম্পর্ক আরও ভালো হবে। এটা তো পরিবর্তন হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রতিবেশী ভারতের যেকোনো ঘটনাই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফল নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ হয়। ফল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা, কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জোর করে শাসনের চেষ্টা করা হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেসময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। সরাসরি সমর্থন, আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং মাতৃসুলভ আচরণে খুব অল্প সময়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যেমন ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তেমনি ভারতের নির্বাচনও বাংলাদেশের কাছে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। নানা হিসাব-নিকাশে বাঙালি সমর্থনের দলটির পক্ষভুক্ত হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ধারবাহিকতা ভারতের জাতীয় নির্বাচন এখন সারা বিশ্বে একটি মডেল। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত তিনটি সরকারের আমলে যে দেশটির সঙ্গে তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সে দেশটি নিঃসন্দেহে ভারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন মেয়াদেও সেই ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বিগত দেড় দশকে ক্রমশ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত একাধিকবার বলেছে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশই তাদের ‘সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’। এই সময়ে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি বা সংযোগ, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন, স্থল ও সমুদ্রসীমায় বিরোধ নিরসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় অভাবনীয় অগ্রগতিও লক্ষ্য করা যায়।

শেখ হাসিনা বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ভারত ও চীন দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখেছেন। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চীনকে প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী হিসেবে ভারত এই সত্য অবশ্যই বুঝতে পারছে। শেখ হাসিনা সরকার কখনো ভারতবিরোধী কার্যকলাপে কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না। এই সত্য ১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই প্রমাণিত হয়েছে। সরকার এই নীতি এখনও বজায়ে রেখেছে এবং ভারত এটা বিশ্বাসও করে। চীনের মতামত উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ‘কোয়াড’ জোটে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মনে করেছে, এই জোটে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন।

শুধু মহান মুক্তিযুদ্ধ নয়, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠিত হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তান সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই ঋণের কথা ভুলে যাননি। পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে ঢাকা ফেরার পথে তাই তিনি দিল্লি অবতরণ করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। ভারতের মাটিতে বসেই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তরিক সহায়তার জন্য ভারত সরকার ও সেদেশের জনসাধারণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এক কথায় ফিরিয়ে নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় সৈন্য।

২০২৪ এর শুরুতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের প্রতিবেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের সমর্থন আদায়েরও চেষ্টা করেছিল তারা। নরেন্দ্র মোদি সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। উপরন্তু তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে। এছাড়া করোনা মহামারির সময় ভারতই প্রথম আমাদের টিকা দিয়ে সহায়তা করেছে।

গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদি তার যোগ্যতা দিয়ে অন্যতম বিশ্বনেতা হয়ে উঠেছেন। সঠিক বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে ভারতকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব রাজনীতির অনন্য উচ্চতায়। একজন চা বিক্রেতা থেকে এই ভারতীয় নেতা দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। তার পরিপক্ব রাজনীতি ভারতীয় জনতা পার্টিকে পরপর তিনবার ক্ষমতায় বসাতে সক্ষম হয়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
The Dogs of Khalishapur and Rakibs thesis is a fresh idea

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ একটি নতুন ভাবনা

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ একটি নতুন ভাবনা
লেখক চমৎকার বইটিতে নানা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে ওই সব ভয়ঙ্কর কুকুর-মানবদের চরিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

সাংবাদিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের ‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ উপন্যাস নিয়ে কিছু কথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরার খুব ইচ্ছা থেকেই লিখতে বসা। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগে সুবাদে বইটি লেখার শুরুর আগেই আলোচনা এবং পরে পান্ডুলিপি থেকেই পড়ার সুযোগ হয়েছে। এতে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের চিরন্তন সত্য কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন লেখক।

বইটি না পড়লে বা না ধরলে আসলে চমৎকার কিছু বিষয় জানা থেকে পাঠকরা বঞ্চিত হবেন। আমি মনে করি, বইটি সবারই পড়া উচিত।

আমরা যদি বইমেলা থেকে সবসময় শুধু বিখ্যাত লেখকদের বই কিনি আর পড়ি, তাহলে এতসব অসাধারণ লেখাগুলো অজানাই থেকে যাবে। নতুন লেখক বা আরেকজন হুমায়ুন আজাদ কিংবা হুমায়ূন আহমেদ অথবা তার চেয়ে বেশি কেউ সৃষ্টি হবে না।

তবে নিশ্চয়ই বলছি না, বিখ্যাত লেখকদের বই কেউ পড়বেন না। অবশ্যই কিনবেন এবং পড়বেন। পাশাপাশি নতুন লেখকদের ভালো ভালো বইগুলোও স্পর্শ করতে হবে, দেখতে হবে ভেতরে কী আছে। তবেই তারা লিখতে উৎসাহ পাবেন, নাহলে তো আর লেখক সৃষ্টি হবে না।

সাংবাদিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস বইটি পড়ে মনে হয়েছে, এটি পড়ে পাঠক মজা পাবেন এবং ভাববেন।

বইটিতে লেখক যা বলতে চেয়েছেন তা অনেকটা এরকম- আমরা প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত। এরমধ্যে কিছু মানুষ থাকে মুখোশ পরা, মুখোশটা মুখের সেঙ্গ খুব কৌশলে নিখুঁতভাবে মেশানো, সহজে দেখা যায় না। চারপাশটা ঘিরে তাদের বিচরণ। আমরা খুব বেশি খেয়াল না করলে বুঝতে পারি না, এদের ভেতর হিংস্র এক কুকুরের বাস। তারা প্রতি মুহূর্তে বন্ধুবেশে মানুষের চরম ক্ষতি করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে; অনেকটা অজগর সাপের মতো।

এ প্রসঙ্গে আমার বন্ধু শারমিন মিলির একটি গল্প বলি। গল্পটি এরকম- এক লোক একটি অজগর সাপ পোষেন। তো এক পর্যায়ে দেখা গেল, অজগরটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে সাপের মালিক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। তিনি চিকিৎসককে জানালেন, সাপটি এরকম ছিল না, তাকে খুবই ভালোবাসত, সবসময় তাকে জড়িয়ে ধরে থাকত, কিন্তু এখন যেন কেমন হয়ে গেছে! তখন চিকিৎসক হেসে বলেন, সাপটি আসলে তাকে কখনোই ভালোবাসেনি। সারাক্ষণ যে জড়িয়ে থাকত, সেটি আসলে প্রতি মুহূর্তে সে দেখত- তিনি সাপটির খাওয়ার উপযোগী হয়েছেন কি না। বইটি অজগরের গল্প বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে।

লেখক চমৎকার বইটিতে নানা অণুগল্পের মধ্য দিয়ে ওই সব ভয়ঙ্কর কুকুর-মানবদের চরিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটিতে রকিব, অংকন, কেয়া, ফাহমিদাসহ বেশ কিছু চরিত্র দাঁড়িয়েছে, সেসব বাংলা উপন্যাসে নতুন মাত্র। উপন্যাসটি পড়ে বারবার মনে হয়েছে- চরিত্র সৃষ্টির নয়া কারিগরের আবির্ভাব হলো।

আমি হলফ করে বলতে পারি, ‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’ পড়লে পাঠকের অবশ্যই অনেক ভালো লাগবে। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক রকম আকর্ষণ বা মাদকতা আছে। অসাধারণ এক কাহিনী। আমি পাঠক হিসেবে, আহ্বান জানাই- পাঠকরা যেনো বইমেলায় গিয়ে মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাসটি সংগ্রহ করেন এবং সময় নিয়ে বইটি পড়েন।

‘খলিশাপুরের কুকুরগুলো ও রকিবের থিসিস’-এর প্রকাশক বেহুলা বাংলা। অমর একুশে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ২২৪ নম্বর স্টলে গেলেই মিলবে, এছাড়া রকমারি তো আছেই।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন:
ফটোগ্রাফি নিয়ে ভিন্নধর্মী বই ‘বিখ্যাত ছবির পেছনের গল্প’
বইমেলায় মীরাক্কেল খ্যাত রাশেদের ‘ফিলিং চিলিং’

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
One of the ethos of Ekush is to protest injustice and end domination over the weak

একুশের অন্যতম চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দুর্বলের ওপর আধিপত্যের অবসান

একুশের অন্যতম চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দুর্বলের ওপর আধিপত্যের অবসান মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্ত স্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এটি।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। আর এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য । ১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগ থেকেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক।পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

২১ শে ফেব্রুয়ারি রক্ত স্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হবে বিশ্বজুড়ে। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন এটি।

মহান আন্তজার্তিক মাতৃ ভাষা ২১ ফেব্রুয়ারীতে যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে মায়ের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে তাদের অধীন করে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। আজ আমরা গর্বিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাসিন্দা।

১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি।

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ করে নতুন মাত্রা। শহীদদের রক্ত তাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে প্রেরণা জোগায়। এর পরের ইতিহাস পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের।

স্বাধীনতাসংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি। তেমনি একুশ আজও পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষার অধিকার অর্জনেরও পথিকৃৎ হয়ে আছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণীত করেন বঙ্গবন্ধু। এটিই একমাত্র দলিল যা বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাকে তুলে ধরেন। ’৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

আর বাঙালি মুক্ত হয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাই একুশ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অন্তহীন প্রেরণার উৎস।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশের অন্যতম চেতনা ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদির অবসান। বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখা।

অমর একুশের চেতনা এখন বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অনুপ্রেরণার উৎস। তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঠিক চর্চা ও সংরক্ষণে আমাদের আরও বেশি পরিশ্রমী হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদে আমরা এখন একই বৈশ্বিক গ্রামের বাসিন্দা। তাই উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বিভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

আমি বিশ্বাস করি যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন আমাদের নিজস্ব ভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

অমর একুশের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হোক, বৈষম্যহীন বর্ণিল পৃথিবী গড়ে উঠুক- শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটাও আমাদের প্রত্যাশা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে প্রতিবারই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। তার সরকার বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরও ভাষার চর্চার ব্যাবস্থা করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছেন, যেখানে হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলাসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ‘আমাদের শিল্প, কলা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে আরো উন্নতমানের করে শুধু আমাদের দেশে না, বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে চান। ‘আমাদের সাহিত্য আরো অনুবাদ হোক। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ আমাদের সাহিত্যকে জানুক, আমাদের সংস্কৃতিকে জানুক, সেটাই আমরা চাই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র অসাধারণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য ধারাবাহিক অগ্রগতি আর সম্মানের পথটি দিন দিন প্রশস্ত করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের কাজে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায় চার দশকের। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশে চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলে প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ তথা জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবেই।

সব মাতৃ ও আঞ্চলিক ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিয়ে সংরক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে বিশ্ববাসীর। একুশের শহীদদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।

লেখক: সাবেক সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি এলাকার মনোনীত প্রতিনিধি।

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
Awami Leagues manifesto has a special commitment to protect the interests of minorities

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকার

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকার
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই ঘুরে-ফিরে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিশেষ অঙ্গীকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের ইশতেহারের স্লোগান- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’।

ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করে ১১টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা, দেশের রূপান্তর ও উন্নয়নে তরুণ এবং যুব সমাজকে সম্পৃক্ত রাখা, পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, ঋণ-কর-বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় এনে তাদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রতিশ্রতি দিয়েছে দলটি। এছাড়া গুরুত্ব পেয়েছে কৃষি, সেবা, অর্থনৈতিক ও শিল্প উৎপাদন খাত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এটিতে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ছিলো।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ ডিসেম্বর ইশতেহার ঘোষণা করেন। নির্বাচনি ইশতেহারের সারাংশ তুলে ধরেন তিনি।

ইশতেহারে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’- এই চারটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেয়া হয়। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজের কথা উল্লেখ করা হয়।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যে ১১টি বিষয়কে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে তা হলো- দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো; ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে কী পরিবল্পনা আছে তা তুলে ধরেছে ইশতেহারে। নতুন করে সরকার গঠন করতে পারলে আওয়ামী লীগ কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা স্পষ্ট করে জানিয়েছে ইশতেহারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল মিলে প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৩০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষের সম-অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেই আলোকে আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটানো; তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয় ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এবং জীবনমানের উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে। তাতে কেউ বাধা প্রদান করতে পারবে না।

বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, জন্মাষ্টমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এসব উদযাপিত হয়।

জাতীয় চেতনায় ও শান্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগান সামনে রেখে সব ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষ সাড়ম্বরে পালন করে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব। এ বছর ৩২ হাজার পূজামণ্ডপে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পূজা উদযাপিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের দেশের সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাই সকলে সমান অধিকার নিয়ে এদেশে বাস করবেন।

ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি, বসতভিটা, উপাসনালয়, বনাঞ্চল, জলাভূমি ও অন্যান্য সম্পদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জমি ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং তা থাকবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণকে সমাজের ও উন্নয়নের মূলস্রোতে আনার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও চা-বাগান শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত আছে।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলোর বৈচিত্র্যময় রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করার জন্য সরকারের তরফ থেকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জাতিগত সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে স্থানীয়, ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটনশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ, কফি-কাজু বাদাম চাষ, তুলা চাষ, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি জনমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মন্দির, শ্মশান, প্যাগোডা, গির্জা, সিমেট্রির উন্নয়নে অনুদান প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসমূহের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সার্বিক কল্যাণ সাধনে নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩(ক) তে বলা আছে, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংবিধানের এই ধারা সুরক্ষায় উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং অর্পিত সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগে বাধা দূর করা হবে।

সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে। আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আবশ্যক পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিংস্র আক্রমণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অসংখ্য নর-নারী নিহত হয়েছে; অসংখ্য নারী হয়েছে ধর্ষণের শিকার; তাদের ঘরবাড়ি, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল ও লুণ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ অমানবিক ঘটনাগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন করবে এবং তার পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও চা-বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মান-মর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করার নীতি অব্যাহত রাখবে। বস্তি, চর, হাওর, বাওড়, উপকূলসহ দেশের সব অনগ্রসর অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন এবং ওইসব অঞ্চলের জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন অগ্রাধিকার পাবে।

বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মোট জনসংখ্যার একটি অংশ দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়। সমাজে চরমভাবে অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন, উপেক্ষিত এ জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের মূল স্রোতে নিয়ে আসার কর্মসূচি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারবদ্ধ।

দলিত, হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোররেশনে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। মুন্ডা, ট্রান্সজেন্ডার, কুষ্ট রোগীদের অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ২ কাঠা জমিতে তাদেরকে ঘর করে দেয়া হয়েছে।

২০১২-২০১৩ অর্থবছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে ৭টি জেলায় বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে মোট ৬৪ জেলায় এই কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি স্বতন্ত্র দুটি কর্মসূচিতে বিভক্ত করা হয়। দুটো কর্মসূচিই সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রমে উপকারভোগীর সংখ্যা ৮২ হাজার ৫০৩ জনে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৩০০ জনে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি দেয়া হয়েছে। বেদে ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেদে ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে, যাতে তারা আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজের মূল স্রোতোধারায় আসতে পারে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সাহায্য ও বাসস্থান প্রদান কর্মসূচি সারা দেশে সম্প্রসারিত করা হবে।

ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। আবহমানকাল থেকেই এ জনগোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত, মানবেতর জীবনযাপন করছে। আওয়ামী লীগ সরকার এই সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে নানা কল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হয়। ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০০৬ সালে ১ হাজার ১২ জন ছিল, যা ২০২২-২৩ সালে ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৮৮৪ জন হয়েছে। বিশেষ ভাতা পান ৫ হাজার ৬২০ জন। ২০১৪ সালে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে এই সম্প্রদায়ের লোকজন স্বতন্ত্র লৈঙ্গিক পরিচয়ে ভোটাধিকার লাভ করে।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহারে সমান অধিকার ও মর্যাদার বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছে। সবার বিশ্বাস নতুন সরকার গঠনের পর সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নিম্নবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি গুরুতর সমস্যা। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নানা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়েও আভাস দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে।

মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে শুধু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই বার বার ঘুরেফিরে এসেছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার, সুযোগ-সুবিধার কথা উঠে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

মন্তব্য

বিশ্লেষণ
How many lives were sacrificed?
বঙ্গবন্ধুর ‘বড়ভাই’ শহীদ ডা. জিকরুল হক স্মরণে

কত প্রাণ হলো বলিদান

কত প্রাণ হলো বলিদান সত্তরের নির্বাচনের আগে সৈয়দপুরে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে শহীদ ডা. জিকরুল হক। তার পেছনে দাঁড়ানো তাজউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা’।

বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ে লেখা কবি শামসুর রাহমানের কবিতাটি একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালি জাতির জীবনে। আজ থেকে ৫২ বছর আগে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানেই পরাজয় মেনে মাথা নত করে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সেই সব বীর শহীদের। স্বাধীনতার ওই লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার পেছনে রয়েছে সন্তান হারানো লাখো মায়ের আর্তনাদ, পিতা হারানো সন্তানের চিৎকার, সম্ভ্রম হারানো নারীর আহাজারি, অগণিত মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা। যাদের ঋণ স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো দিন শোধ করতে পারবে না।

বিজয়ের ৫২ বছর পেরিয়ে এসেছে জাতি। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়েও আজও অনেকের ত্যাগ ও বীরত্বগাথা অজানাই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে এমনই একজন ত্যাগী বীর ছিলেন শহীদ ডা. জিকরুল হক।

জিকরুল হক ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপিএ (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নির্বাচনী এলাকা ছিল অবাঙালি-অধ্যুষিত। তা সত্ত্বেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। মূলত জনসেবা, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি কাজে জড়িত থাকার কারণে। তিনি একজন চিকিৎসক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে খ্যাতিমান ছিলেন।

জিকরুল হকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. মোনায়মুল হক দৈনিক বাংলাকে জানান, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাবাকে ‘বড়ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। একাত্তরের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিকেল ৩/৪টার দিকে ফোনে কথা হয় তার বাবার। বঙ্গবন্ধু সৈয়দপুর শহরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার কাছ থেকে জানার পর আত্মগোপনে যেতে বলেছিলেন। বাবা তা করেননি।”

২৫ মার্চ রাতেই সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল জিকরুল হককে তার নতুন বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এরপর ১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্টের নিসবেতগঞ্জে এক বধ্যভূমিতে জিকরুল হকসহ মোট ১৫০ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক সহচরও ছিলেন।

মোনায়মুল হক আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিকরুল হকের আপন দুই ভাই জহুরুল হক ও আমিনুল হক এবং ভাইপো কুদরত-ই-এলাহীসহ আট আত্মীয় শহীদ হন। তার দুই ভাইয়ের একজনকে জুন মাসের মাঝামাঝি এবং আরেকজনকে ১৪ ডিসেম্বর অবাঙালিরা হত্যা করে। ১৯৯৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ডাক বিভাগে তার নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন।

পাকিস্তানি শাসনামলে এক অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় স্থানীয় অবাঙালিরা সৈয়দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠে উর্দু স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অবাঙালি অধ্যুষিত একই এলাকায় পাশাপাশি দুটি স্কুল নির্মাণ হলে সহিংসতার শঙ্কা ছিল। জিকরুল হক স্থানীয় নেতা ও বাঙালিদের সহযোগিতায় উর্দু স্কুল নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

জিকরুল হকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সৈয়দপুরে। তার আদি পৈতৃক নিবাস দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার পলাশবাড়ীতে। বাবা শেখ জিয়ারতউল্লাহ আহমদ, মা খমিউননেছা চৌধুরানী। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। জিকরুল হক নয় ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

১৯৩৩ সালে সৈয়দপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুল থেকে এলএমএফ পাস করেন। মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

কলকাতা ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্যে আসেন এবং ভারত ভাগের পর তাদের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। জিকরুল হক থানা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি এবং পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের আমরণ সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

মন্তব্য

p
উপরে